বিশ্ব

নিউইয়কের মেয়র নির্বাচন: এগিয়ে মুসলিম প্রার্থী মামদানি

Advertisement

নিউইয়র্ক সিটির ৩৭তম মেয়র নির্বাচনের উত্তেজনা ক্রমশ তীব্র আকার নিচ্ছে। আজ, মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলছে। প্রায় ৫.১ মিলিয়ন নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার নিউইয়র্কবাসী আগাম ভোট দিয়েছেন। ভোট গণনার পরই জানা যাবে কে হবেন নতুন মেয়র।

বর্তমান রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। যদি তিনি জয়ী হন, তাহলে নিউইয়র্কে প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে ইতিহাস গড়বেন।

জোহরান মামদানি: মুসলিম ও এশীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থীর উত্থান

৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি একজন স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান এবং প্রগতিশীল রাজনীতির পরিচিত মুখ। জন্মগ্রহণ করেছেন উগান্ডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে, কিন্তু বেড়ে উঠেছেন নিউইয়র্কে। বাংলাদেশি সম্প্রদায় তাকে নিজেদের একজন প্রার্থী মনে করছেন। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি পাড়াগুলোতে এখন উৎসবের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

জোহরান নিজেও বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অনেকেই এখানে আছেন। যেমন বাংলাদেশি আঙ্কেলরা। বাংলাদেশি তরুণদের মতো তারাও আমাদের পাশে আছেন।”

তিনি মূলত গণপরিবহন, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সহজলভ্যতার মাধ্যমে একটি মানবিক শহর গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। তার বার্তা স্পষ্ট: নিউইয়র্কের সকল নাগরিকই সমান মর্যাদা এবং সুযোগের অধিকার পাবেন।

নির্বাচনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

নিউইয়র্ক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী। চারশো বছরের ইতিহাসে কখনও কোনো মুসলিম বা এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র নির্বাচিত হননি। বর্তমানে শহরের প্রায় ৯ শতাংশ ভোটার মুসলিম এবং এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের হার ২০ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভোটাররাই এবার নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

জোহরান মামদানি ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, “এখানকার প্রায় ১০ লাখ মুসলিম বাসিন্দা সকল মানুষের সমান অধিকার ও সম্মানের দাবি জানায়। মুসলিমরাও অন্যদের মতোই সুরক্ষা, সুযোগ এবং মর্যাদার অধিকার পেতে চায়।”

তিনি আরও বলেন, “আমি এমন কোনো সিটি হল তৈরি করব না যেখানে নাগরিকরা শুধু বসে থাকবে। এমন একটি সিটি হল চাই যেখানে সবাই আসবে এবং অনুভব করবে যে সরকার তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করে, এবং তাদের পরিচয় যাই হোক না কেন, তাদের জন্য লড়াই করে।”

সমর্থক ও চ্যালেঞ্জ

নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক সমীকরণ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। ডেমোক্র্যাটিক মেয়র এরিক এডামস প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোর সমর্থন ঘোষণা করেছেন। এদিকে, মিডিয়া ও কিছু রাজনৈতিক চাপ জোহরানের প্রচারণায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করেছেন। মোদিপন্থি ভারতীয় সম্প্রদায়ও জোহরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে মুসলিম এবং প্রগতিশীল প্রার্থীকে আটকানোই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে জোহরানের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সেলিব্রিটি। তাদের মধ্যে আছেন বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-কোর্টেজ, হেকিম জেফরিস এবং নিউইয়র্কের বর্তমান গভর্নর। এছাড়াও, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থন কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মন জয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

নিউইয়র্কের নির্বাচনে ধর্ম, সংস্কৃতি ও প্রজন্মের প্রভাব

নিউইয়র্কের এই মেয়র নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক লড়াই নয়। এটি ধর্ম, সংস্কৃতি ও প্রজন্মের প্রতিফলন। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট এবং এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের সমর্থন এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহরের ভোটাররা এবার প্রগতিশীল নীতি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বৈচিত্র্যময় নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। জোহরানের প্রার্থীতা এবং জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, নিউইয়র্কবাসী এখন ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির বাইরেও নেতার যোগ্যতা ও নীতি মূল্যায়ন করছে।

জোহরানের নীতি ও পরিকল্পনা

জোহরান মামদানি তার নির্বাচনী প্রচারণায় চারটি মূল বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন:

  1. বাসস্থান ও হাউজিং: তিনি শহরে সস্তা ও মানসম্মত বাসস্থান নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা করেছেন, যাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারও সহজে বাস করতে পারে।
  2. গণপরিবহন: শহরের সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য গণপরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করা।
  3. শিক্ষা: শিশু ও কিশোরদের জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  4. স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য এবং সকল নাগরিকের জন্য সাশ্রয়ী হবে।

তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বলেছেন, “নিউইয়র্ক এমন একটি শহর হতে হবে যেখানে সবাই নিরাপদ, সমান অধিকার ভোগ করবে এবং নিজেদের পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করবে।”

ইতিহাসের সাক্ষী

ইতিহাসে কখনও কোনো মুসলিম বা এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি নিউইয়র্কের মেয়র হয়নি। জোহরান মামদানি যদি জয়ী হন, তাহলে তিনি ইতিহাসের পাতায় প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নাম লিখাবেন।

নিউইয়র্কবাসীর চোখ এখন নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। এটি শুধুই রাজনৈতিক লড়াই নয়; এটি এক যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুহূর্ত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম ও এশীয় নাগরিকরা, প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছেন।

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানি প্রার্থীতা শুধু একটি রাজনৈতিক লড়াই নয়, এটি ধর্ম, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল নীতির প্রতিফলন। তার জয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখতে পারে। আজকের দিন নিউইয়র্কবাসী এবং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই নির্বাচনের ফলাফল ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক নির্দেশ করবে।

নিউইয়র্কবাসী যখন ভোটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তখন তারা কেবল একজন মেয়র বেছে নিচ্ছেন না, বরং একটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের প্রতিফলন দেখাচ্ছেন। জোহরান মামদানির প্রার্থীতা এশীয় ও মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আশা ও প্রেরণার প্রতীক।

নিউইয়র্কের ইতিহাসের পাতায় এবার নতুন একটি অধ্যায় লিখবে কে, তা জানা যাবে রাতের অন্ধকার কাটার পর।

MAH – 13621 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button