আফগানিস্তান সরকার ও ইমারাতে ইসলামিয়া দল সম্প্রতি এক উদ্বেগজনক অভিযোগ তুলে ধরেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে আফগানিস্তানের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করছে। দেশটির সরকার মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ রবিবার (২ নভেম্বর) এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য জানান।
মুজাহিদ বলেন, “আমেরিকার ড্রোনগুলি আফগান আকাশসীমায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তারা পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করে আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে, যা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এই অবস্থায় অসহায়, এবং এটি থামাতে আমাদের সক্ষমতা নেই।” তিনি আরও বলেন, এটি এক ধরনের অক্ষমতা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ইস্তাম্বুল আলোচনার প্রেক্ষাপট
জবিহুল্লাহ মুজাহিদ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক আলোচনার প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান বারবার দাবি করে থাকে যে, আফগান ভূমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। ঠিক একইভাবে, ইমারাত সরকারের প্রতিনিধিরাও আলোচনায় ইসলামাবাদকে নিশ্চিত করার অনুরোধ করেছেন যে, আফগান ভূমি ও আকাশ সীমা যেন কোনো পক্ষের দ্বারা আফগান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পাকিস্তানের একটি বিশেষ সামরিক গোষ্ঠীকে বিশ্ব শক্তিগুলো ইন্ধন জুগিয়ে থাকতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, যারা একসময় আফগানিস্তানের সাথে সংঘাতে জড়িত ছিল অথবা বাগরাম অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতো, তারা এখন চাপ ও উস্কানির মাধ্যমে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চাইছে।”
মুজাহিদ আরও বলেন, “আমাদের সন্দেহ রয়েছে যে, এই চাপের পেছনে প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলো রয়েছে। তারা সরাসরি প্রকাশ্যে আসে না, বরং আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে অন্যদের ব্যবহার করে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ ও জনগণকে নিরাপদ রাখা আমাদের মূল লক্ষ্য।”
ইমারাত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
ইমারাত সরকার বারবার প্রকাশ করেছে যে, তারা যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে। মুজাহিদ বলেন, “আমরা এই অঞ্চলে কোনো বিপথগামী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত হতে দেবো না। যেকোনো প্রয়াস, যা আমাদের দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ, তা কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।”
তিনি আরও জানান, ইমারাত সরকার পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় একমাত্র অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে টিটিপি (TTP – তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান) চিহ্নিত করেছে। ইসলামাবাদ আশা করে, ইমারাত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে কাবুল স্পষ্ট জানিয়েছে, এটি তাদের ক্ষমতার বাইরে।
মুজাহিদ জোর দিয়ে বলেন, “টিটিপি আমাদের সরকারের ছত্রছায়ায় কাজ করে না। এটি পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চলে স্বতন্ত্র নীতি ও কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই আমাদের উপর কোনো ধরনের চাপ আরোপ করা যুক্তিসঙ্গত নয়।”
আফগান-আমেরিকা সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ইমারাত ইসলামিয়া দল ও আফগান সরকারের এই উদ্বেগের পেছনে মূল কারণ হলো মার্কিন ড্রোনের কার্যক্রম। আফগান ভূখণ্ডে মার্কিন ড্রোনের উপস্থিতি এক দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে আসে। ২০০১ সালের পর থেকে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মার্কিন ড্রোনের হামলা চলছিল। এই হামলা সাধারণত তালেবান, আলকায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করত।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান সরকার অভিযোগ করেছে যে, মার্কিন ড্রোন প্রায়ই পাকিস্তান হয়ে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে কেবল আফগান সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের জটিলতা
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ইতিহাসভিত্তিকভাবে জটিল। সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায়শই উভয় দেশের মধ্যে সংঘাত ও অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান প্রায়শই অভিযোগ করে, আফগান ভূখণ্ড তাদের সীমান্তবর্তী নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। একইভাবে, আফগান সরকার অভিযোগ করে যে, পাকিস্তান কিছু উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
মুজাহিদ ইস্তাম্বুল আলোচনায় বলেন, “আমরা আশা করি, পাকিস্তান আমাদের আকাশসীমা ও ভূখণ্ডকে কোনো অপব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না। এটি উভয় দেশের স্থায়ী শান্তি ও সহযোগিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন ড্রোন হামলা ও পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিশ্ব শক্তিগুলো গভীরভাবে জড়িত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কিছু বৈশ্বিক শক্তি সরাসরি পদক্ষেপ নেয় না; বরং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে স্থানীয় পক্ষকে উৎসাহিত করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা আফগানিস্তানে দীর্ঘকাল ধরে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমে যুক্ত, তারা সাধারণত প্রকাশ্যে এ ধরনের সংঘর্ষে প্রবেশ করে না। তবে আফগান সরকারের অভিযোগ, ড্রোনের কার্যক্রম আফগান আকাশ সীমায় প্রবেশ করে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আফগান জনগণের উদ্বেগ
সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ ড্রোন কার্যক্রম ও পাকিস্তানের সামরিক কর্মকাণ্ডের কারণে আতঙ্কিত। স্থানীয়রা জানাচ্ছে, “আমরা আমাদের বাড়ি ও নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। ড্রোনের উপস্থিতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আফগান সরকারের উচিত এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরা, যাতে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা যায়।
ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা
ইমারাত ইসলামিয়া দল এবং আফগান সরকার বারবার বলেছে, তারা সকল ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে। জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো হুমকি বরদাস্ত করা হবে না। আমরা প্রস্তুত আছি যাতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং জনগণ নিরাপদ থাকে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইমারাতের এই দৃঢ় অবস্থান পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে মার্কিন ড্রোন কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এই সমস্যা সমাধান এখনও চ্যালেঞ্জিং।
আফগান সরকার ও ইমারাত ইসলামিয়া দলের সাম্প্রতিক মন্তব্য প্রমাণ করছে যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত ও আকাশসীমা নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। মার্কিন ড্রোনের কার্যক্রম, পাকিস্তানের সামরিক নীতি, এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফগান সরকার দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে যে, তারা যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এখন শুধু দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির একটি জটিল প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েছে।
MAH – 13608 I Signalbd.com
				
					


