উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফের কাছে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে অন্তত ২০ জন নিহত এবং ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। রাতের আঁধারে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পে বহু ঘরবাড়ি ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভূমিকম্পের বিস্তারিত ও ক্ষয়ক্ষতি
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিসি) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় সোমবার রাত ১২টা ৫৯ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ২৯ মিনিটে) মাজার-ই-শরীফের কাছে বালখ প্রদেশের খোলম এলাকায় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার গভীরে।
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের আশেপাশের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, এবং মানুষ আতঙ্কে রাতের অন্ধকারে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভিড়ে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বালখ প্রাদেশিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
একজন কর্মকর্তা জানান, “রাত থেকে ভোর পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। অনেক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও লাশ থাকতে পারে।”
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ
মাজার-ই-শরীফে প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যখন হঠাৎ ভবন কেঁপে ওঠে এবং বিদ্যুৎ চলে যায়। বহু বাসিন্দা ঘুমন্ত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছুটে আসেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হামিদুল্লাহ বলেন, “আমি ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ মাটি কাঁপতে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাড়ির ছাদ কাঁপতে থাকে, আমরা সবাই বাইরে বেরিয়ে যাই। সারা রাত খোলা মাঠে ছিলাম।”
অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শহরের ঐতিহাসিক নীল মসজিদের আশেপাশেও দেয়ালে ফাটল দেখা গেছে এবং মসজিদের প্রাঙ্গণে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছে।
উদ্ধারকাজে ব্যস্ত তালেবান কর্তৃপক্ষ
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেনা ও উদ্ধার দল পাঠানো হয়েছে। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করছে, যাতে ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষদের দ্রুত উদ্ধার করা যায়।
কাবুল পুলিশের মুখপাত্র খালিদ জাদরান জানিয়েছেন, “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।”
এছাড়া, আহতদের চিকিৎসার জন্য মাজার-ই-শরীফ ও সামানগান প্রদেশের হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স পাঠানো হয়েছে।
আগের ভূমিকম্পগুলোর স্মৃতি এখনো তাজা
এটি চলতি বছরে আফগানিস্তানে সংঘটিত অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প। এর আগে আগস্টের শেষের দিকে পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় ৬.০ মাত্রার আরেক ভূমিকম্পে এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হওয়ায় এমন দুর্যোগ প্রায়ই ঘটে। দেশটির অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় সামান্য কম্পনেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশটি বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে।
অবকাঠামো ও প্রস্তুতির অভাবই বড় ঝুঁকি
বিশ্লেষক ও ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বিল্ডিং কোড ও দুর্যোগ প্রস্তুতি যথেষ্ট দুর্বল। তাই মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও সেখানে ভয়াবহ প্রাণহানি ডেকে আনে।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ আব্দুল করিম বলেন, “ভূমিকম্পের সময় মানুষ জানে না কীভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয়। জরুরি প্রশিক্ষণের অভাব এবং পুরনো ভবনগুলো ধ্বংসের প্রধান কারণ।”
তিনি আরও বলেন, “যদি সরকার সঠিকভাবে পুনর্গঠন ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়, ভবিষ্যতে এমন প্রাণহানি কমানো সম্ভব।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহায়তার আহ্বান
ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক দপ্তর জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য জরুরি খাদ্য, পানি ও তাঁবু সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস জানিয়েছে, তারা স্থানীয় দলের সঙ্গে সমন্বয় করে আহতদের উদ্ধার ও চিকিৎসায় কাজ করছে। তবে পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ত্রাণ পৌঁছাতে সময় লাগছে।
পুনর্গঠনের পথে নতুন চ্যালেঞ্জ
আফগানিস্তানে এই ভূমিকম্প আবারও মনে করিয়ে দিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুর্বল অবকাঠামো ও গরিব জনগোষ্ঠী। বর্তমানে দেশটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে বড় আকারের পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে স্থানীয় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার হলে ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এম আর এম – ২০৬২,Signalbd.com



