অন্তর্বর্তী সরকারই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নেতৃত্ব দেবে

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতি এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এই দায়িত্ব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে এসে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ দেখাতে হলে নীতিনির্ধারকদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
এই প্রসঙ্গে শনিবার রাজধানীর আইসিএবি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সাবেক গভর্নর ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিকথা শীর্ষক বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ মোড়ক উন্মোচন করা হয়। দৈনিক বণিক বার্তা প্রকাশিত এই বইটি মূলত অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই। জনগণের জন্য মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে চাই।’ তবে তিনি স্বীকার করেন যে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সহজ নয় এবং এটি সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া।
দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে। বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সুস্পষ্ট নীতি ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের গতি শ্লথ, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত না হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।’
ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যাংক খাতের সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন লেখক ও বিশ্লেষক ফারুক মঈনউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রাজনৈতিক চাপ কম থাকায় ব্যাংক খাত সংস্কারের সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
এ ছাড়া তিনি প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও তাঁদের আয় আরও কার্যকরভাবে বিনিয়োগ করার ওপর জোর দেন। তাঁর মতে, প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি আরও কাঠামোগতভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
নীতি নির্ধারণে গভর্নরের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, গভর্নরদের রাজনৈতিক চাপে দেশ ছাড়তে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতি গ্রহণ করা।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ষাটের দশকের রাজনীতির একটি চিত্র পাওয়া যায় গভর্নরের স্মৃতিকথা বইয়ে। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনতে হলে রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং কর ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।’
সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার তাগিদ
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘দেশকে উন্নত করতে হলে গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ পিছিয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যদি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, তবে সংকট আরও গভীর হতে পারে।’
সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
বক্তাদের আলোচনায় উঠে আসে যে, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অস্থায়ী সিদ্ধান্ত ও অদূরদর্শী নীতির কারণে অর্থনীতি আরও বেশি চাপে পড়তে পারে। বক্তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, দ্রুত ও কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। এ ছাড়া অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ অন্যান্য অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি পুনরুদ্ধার সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো, তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকর নীতি গ্রহণ করবে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাত সংস্কার, রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রবাসী আয়ের সঠিক ব্যবহার এবং শহর-গ্রামের বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখন দেখার বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে কতটা সফল হয়।