বিশ্ব

চীনে এসসিও সম্মেলন ২০২৫ মোদি, পুতিন, সি চিন পিংয়ের বৈঠক ও বিশ্বরাজনীতির প্রভাব

Advertisement

চীনের বোহাই সাগরের তীরে অবস্থিত বন্দরনগর তিয়ানজিনে ৩১ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন ২০২৫। দুই দিনের এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের ২০টির বেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, সঙ্গে ১০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান।

এবারের সম্মেলনে বিশেষ নজর কেড়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এটি মোদির ২০১৮ সালের পর প্রথম চীন সফর, এবং চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মোদি-পুতিন-সি চিন পিং বৈঠকের প্রেক্ষাপট

গত বছরের তুলনায় এবারের এসসিও সম্মেলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। ২০২৪ সালে মোদি ভারতের পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি সম্মেলনে যোগ দেবেন না। তবে এবার তিনি চীনে পৌঁছেছেন, যা নতুন সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দেয়।

চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও গত বছরের শেষ দিক থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ভারতের পণ্যের ওপর চীনের আরও কাছাকাছি যেতে এবং দু’দেশের সম্পর্ক জোরদার করতে বাধ্য করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সম্মেলন চীনের জন্য একটি বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা নিজেদের স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে। একদিকে এটি দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে একত্রিত করবে, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করবে।

সম্মেলনের স্থান ও অংশগ্রহণকারীরা

স্থল: তিয়ানজিন, চীন
সময়কাল: ৩১ আগস্ট – ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অংশগ্রহণকারীরা: ২০-এর বেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, ১০টির বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা

মূল অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র ও নেতা:

  • রাশিয়া: ভ্লাদিমির পুতিন
  • ভারত: নরেন্দ্র মোদি
  • চীন: সি চিন পিং
  • ইরান: মাসুদ পেজেশকিয়ান
  • পাকিস্তান: শাহবাজ শরিফ
  • বেলারুশ: আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো
  • কাজাখস্তান: কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ
  • উজবেকিস্তান: শাভকাত মিরজিয়েভ
  • কিরগিজস্তান: সাদির জাপারভ
  • তাজিকিস্তান: ইমোমালি রাহমন

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী:

  • তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
  • মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং
  • নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি
  • ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো
  • মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম
  • মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু

আন্তর্জাতিক সংস্থা:

  • জাতিসংঘ: মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস
  • আসিয়ান: মহাসচিব কাও কিম হর্ন

সম্মেলনের গুরুত্ব

২০২৫ সালের এসসিও সম্মেলন হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন বিশ্ব রাজনীতিতে উচ্চ অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে:

  1. ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ: বিশ্ব বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
  2. ইউক্রেন যুদ্ধ: ইউরোপের নিরাপত্তা প্রেক্ষাপটে জটিলতা বৃদ্ধি করেছে।
  3. মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত: গাজা, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, লেবানন ও ইরানের উত্তেজনা।
  4. দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা: আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীন এবং রাশিয়া এই সম্মেলনের মাধ্যমে দেখাতে চাইবে যে বিশ্ব এখন বহু-মেরুকরণ যুগে প্রবেশ করছে এবং অখণ্ড নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম।

ভারতের ভূমিকা

ভারত এবারের সম্মেলনে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে চায়। মোদি ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখতে চায়।

মধ্য এশিয়ার দেশগুলো চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে এবং নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতার জন্য উপস্থিত। ভারতের জন্য প্রধান কারণ হলো আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন।

বিশ্লেষক মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, “এ সম্মেলন ভারতের জন্য সুযোগ, যেখানে তারা একপক্ষীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে।”

এসসিওর মধ্যে মতবিরোধ

এসসিওর সদস্যদেশগুলো প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে একমত হতে পারে না। উদাহরণ:

  • ইউক্রেন যুদ্ধ: রাশিয়া নিজস্ব স্বার্থে সদস্য দেশগুলোকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলেও ভারত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করছে।
  • ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: এসসিও যৌথভাবে নিন্দা জানায়, তবে ভারত সমর্থন দেয়নি।
  • ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: জোটের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মতবিরোধের কারণ হলো প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রাধান্য।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্ট

যুক্তরাষ্ট্র এসসিও সম্মেলন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলেহান্দ্রো রেইজেস বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতের ওপর নজর রাখবে না, বরং পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও চীনের কৌশলও লক্ষ্য করবে।”

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এবং ভারতের চীন-ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগ্রহ বিশ্ববাণিজ্য ও ভূরাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।

সম্মেলনের সম্ভাব্য ফলাফল

১. দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে একত্রিত করা।
২. চীন-রাশিয়া-ভারত জোটের শক্তি প্রদর্শন।
৩. আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও নিরাপত্তা বিষয়ে যৌথ পদক্ষেপ।
৪. বিশ্ববাণিজ্যে নতুন সমঝোতা ও শুল্ক যুদ্ধ মোকাবিলা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসসিও সম্মেলন ২০২৫ হবে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্রে পাওয়ার ব্যালেন্স এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন শুধু রাজনৈতিক শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়াস। মোদি, পুতিন ও সি চিন পিংয়ের বৈঠক, ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান বিশ্ব রাজনীতির নতুন অধ্যায় সূচিত করছে।

MAH – 12576,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button