
ফিলিস্তিনের গাজ্জা উপত্যকায় আবারও রক্ত ঝরল। ঘোষিত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ হামলায় অন্তত ৯১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৫ জনই শিশু। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
গাজ্জার হাসপাতাল ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হামলাগুলো মূলত শরণার্থী শিবির ও সাধারণ মানুষের বসতবাড়ি লক্ষ্য করে চালানো হয়। অধিকাংশ নিহত ও আহত বেসামরিক নাগরিক—যাদের কেউ ঘুমিয়ে ছিলেন, কেউ খাবারের আয়োজন করছিলেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলাগুলো এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বহু পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা হাতে থাকা সামান্য সরঞ্জাম নিয়ে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির পরও আগ্রাসন
আন্তর্জাতিক মহলের চাপে চলতি সপ্তাহে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের মধ্যে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই চুক্তি কার্যকর হওয়ার একদিনের মাথায়ই নতুন করে বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১১টার পর থেকেই গাজ্জার বিভিন্ন এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আল-শাতি, খান ইউনুস, রাফা ও জাবালিয়া এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। হামলার সময় অনেক এলাকাতে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ফিলিস্তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তায়েফ আবু রায়াশ বলেছেন,
“ইসরায়েল স্পষ্টভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করেছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান হামলা চালানো কোনোভাবেই আত্মরক্ষার অংশ হতে পারে না। এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা।”
হাসপাতালগুলোতে আহতদের আর্তনাদ
গাজ্জার আল-আকসা ও ইন্দোনেশিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের সংখ্যা এত বেশি যে হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের ঘাটতি মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে।
ডা. ইউসুফ হাম্মুদ, আল-আকসা হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন—
“প্রতিদিনই আমরা লাশের সারি দেখছি। কিন্তু শিশুদের বিকৃত দেহ দেখতে দেখতে আমাদের মন ভেঙে যাচ্ছে। এমনকি এখন মর্গে জায়গা না থাকায় অনেক লাশ বরফে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা (UNOCHA) জানায়, গাজ্জার হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ সংকট চরমে। অধিকাংশ চিকিৎসা সরঞ্জাম বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিশু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে।
শরণার্থীদের ওপর আঘাত
গাজ্জা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বাস করে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই জাতিসংঘের নিবন্ধিত শরণার্থী। চলমান সংঘাতে লাখো মানুষ গৃহহীন হয়ে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা সেই শরণার্থী শিবিরগুলোই মূল লক্ষ্যবস্তু করেছে।
রাফা শিবিরের এক বাসিন্দা সালমা ইউসুফ বলেন,
“আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধবিরতির পর হয়তো একটু শান্তি পাব। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আবারও বোমা পড়তে শুরু করে। আমার স্বামী ও দুই সন্তান মারা গেছে। এখন আমি আর বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাই না।”
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) বলেছে, শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় গাজ্জায় অন্তত ১,২০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। এতে প্রায় ৮,০০০ মানুষ নতুন করে গৃহহীন হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, কাতার ও ইন্দোনেশিয়া। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেছেন—
“ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিক আইনের কোনো ধারাকেই সম্মান করছে না। তারা শিশু হত্যা করে নিজেদের নিরাপত্তা বলয়ে ঢাকতে চায়। এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।”
অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,
“গাজ্জায় অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। নিরীহ মানুষকে হত্যা বন্ধ করতে হবে। মানবিক সাহায্যের পথ খুলে দিতে হবে।”
তবে ইসরায়েল তাদের অবস্থানে অনড় থেকে জানিয়েছে, “হামাসের সামরিক ঘাঁটি ও অস্ত্রাগারে” হামলা চালানোই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বোমার আঘাতের শিকার হওয়া স্থানগুলোর বেশিরভাগই ছিল আবাসিক ভবন ও শরণার্থী ক্যাম্প—যা ইসরায়েলের বক্তব্যের সঙ্গে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।
মানবিক সংকটের গভীরতা
চলমান সংঘাতে গাজ্জার মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ ও বিদ্যুতের ঘাটতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজ্জার ৮০ শতাংশ মানুষ এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। শিশু অধিকার সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, গত এক বছরে গাজ্জায় নিহত শিশুদের সংখ্যা বিশ্বের যেকোনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের চেয়ে বেশি।
সংস্থাটির মুখপাত্র হানান আশরাফ বলেন—
“যখন একটি বোমা পড়ে, সেটি শুধু ঘর ধ্বংস করে না, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎও ধ্বংস করে দেয়।”
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
গাজ্জায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নতুন কিছু নয়। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০২১ সালের মতো এবারও একই রক্তাক্ত চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। প্রতিবারই ইসরায়েল ‘হামাস দমন’ এর নামে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিরীহ জনগণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজ্জায় প্রতিটি আগ্রাসনই নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়াচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইতিমধ্যেই গাজ্জার পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে। সেখানে অধিকাংশ দেশ ইসরায়েলের হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেও যুক্তরাষ্ট্র veto প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি আটকে দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি অবিলম্বে কার্যকর যুদ্ধবিরতি না হয়, তাহলে গাজ্জায় মানবিক বিপর্যয় ইতিহাসের ভয়াবহতম রূপ নিতে পারে।
গাজ্জায় প্রতিদিন বাড়ছে লাশের সংখ্যা, কমছে আশার আলো। যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইসরায়েলি বাহিনীর এই নতুন হামলা বিশ্ব বিবেককে আবারও নাড়া দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—কতজন শিশুর রক্ত ঝরলে মানবতা জাগবে?
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হওয়া উচিত। নচেৎ গাজ্জার মানুষ হয়তো কখনও জানতেই পারবে না শান্তি কাকে বলে।
MAH – 13561 I Signalbd.com



