দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আবারও দেখা দিয়েছে নতুন উত্তেজনা। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে সরাসরি নির্মূল করার হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি বলেছেন, “তালেবান শাসন যদি পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে, তাহলে তাদের গুহায় লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হবে।”
বুধবার (২৯ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক তীব্র বার্তায় খাজা আসিফ এই হুঁশিয়ারি দেন, যা মুহূর্তের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
পাকিস্তানের কড়া ভাষায় সতর্কতা
খাজা আসিফ বলেন,
“আমি আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের সতর্ক করতে চাই—তালেবান সরকারকে ধ্বংস করতে পাকিস্তানকে তার সামরিক শক্তির অল্প অংশই ব্যবহার করতে হবে। তারা যদি আমাদের ধৈর্য পরীক্ষা নিতে চায়, তাহলে দুই পায়ের মাঝে লেজ গুঁজে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আবারও এই অঞ্চলের মানুষ দেখতে পাবে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও উপহাস সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। পাকিস্তানের ভেতরে কোনো আত্মঘাতী হামলা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঘটলে তার দায় সরাসরি আফগান সরকারের ওপর বর্তাবে, এবং আমরা কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাব।”
ইস্তাম্বুলে ব্যর্থ শান্তি আলোচনা ও তার পরিণতি
সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে চার দিনব্যাপী শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার মধ্যস্থতা করেন তুরস্ক ও কাতার। কিন্তু এই আলোচনায় কোনো চুক্তি বা সমঝোতা হয়নি।
দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ এবং আশ্রয়দাতাদের ইস্যু নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু কোনো অভিন্ন অবস্থান তৈরি না হওয়ায় আলোচনাটি ব্যর্থ হয়।
রয়টার্সকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে আফগান ও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথম দফায় দোহায় অস্ত্রবিরতির ব্যাপারে আংশিক একমত হয়েছিলেন উভয় পক্ষ। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ইস্তাম্বুল আলোচনায় এসে সেই সমঝোতা পুরোপুরি ভেঙে যায়।
তালেবান সরকারের অবস্থান: ‘পাকিস্তানই দোষী’
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ পাকিস্তানের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন,
“আফগানিস্তান কারও জন্য হুমকি নয়। বরং পাকিস্তান নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকতে আমাদের নাম ব্যবহার করছে।”
তিনি আরও বলেন,
“তালেবান সরকার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তবে কেউ আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে তার জবাব অবশ্যই দেওয়া হবে।”
পাক-আফগান সম্পর্ক: পুরনো বন্ধুত্ব থেকে গভীর অবিশ্বাসে
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক একসময় ছিল গভীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বন্ধুত্বের ওপর ভিত্তি করে। ১৯৯০-এর দশকে তালেবান আন্দোলনের উত্থানের সময় পাকিস্তানই তাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান যখন কাবুল দখল করে, তখন পাকিস্তান ভেবেছিল তাদের প্রভাব বাড়বে। কিন্তু উল্টো ফল হয়।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগান সীমান্ত দিয়ে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। টিটিপি মূলত পাকিস্তানের তালেবান শাখা, যারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে।
ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, টিটিপি সদস্যরা আফগান মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে।
টিটিপির হামলায় ক্ষুব্ধ ইসলামাবাদ
২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় টিটিপির হামলা বেড়ে যায়। শুধু ২০২৪ সালেই প্রায় ২০০-র বেশি নিরাপত্তা সদস্য টিটিপির হামলায় নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর দাবি, এই হামলাগুলোর বেশিরভাগের পরিকল্পনা হয়েছে আফগানিস্তানের খোস্ত, কুনার ও নানগারহার প্রদেশে।
এই পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে তালেবান প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় শান্তি প্রচেষ্টা
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে তুরস্ক ও কাতার গত দুই মাস ধরে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়,
“দুই মুসলিম দেশের মধ্যে রক্তপাত বন্ধ করা জরুরি। উভয় দেশের উচিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করা।”
কিন্তু বাস্তবে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে আস্থার অভাব এতটাই গভীর যে, আলোচনার ফল ইতিবাচক হয়নি।
পাকিস্তানের সামরিক বার্তা: ‘আমরা প্রস্তুত’
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা বাহিনী যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। সীমান্তে সেনা মোতায়েনও বাড়ানো হয়েছে।
ইসলামাবাদে কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বার্তা কেবল তালেবানকেই নয়—বরং আন্তর্জাতিক মহলকেও পাঠানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ মির বলেন,
“পাকিস্তান এখন বুঝতে পারছে, তালেবান শাসন তাদের কৌশলগত স্বপ্ন পূরণ করেনি। বরং, সেটি নিরাপত্তার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।”
দক্ষিণ এশিয়ার নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের এই উত্তেজনা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারত, ইরান ও চীনও এই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ সি. রাজা মোহন বলেন,
“যদি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ হয়, তাহলে পুরো অঞ্চলে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।”
চীনও উদ্বিগ্ন, কারণ তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর অংশ হিসেবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আফগানিস্তানের ভেতরেও অসন্তোষ বাড়ছে
তালেবান সরকারের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক সময়ে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
মহিলাদের শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থান ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে।
এমন অবস্থায় পাকিস্তানের হুমকি তালেবান প্রশাসনের জন্য নতুন এক সংকট সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস দুই দেশের প্রতি সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন,
“দুই প্রতিবেশী মুসলিম দেশের মধ্যে যুদ্ধ নয়, শান্তিই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, আফগানিস্তানকে কোনোভাবেই সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ আশ্রয় হতে দেওয়া যাবে না।
বিশ্লেষণ: সামনে কী হতে পারে
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান এখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থানের চাপে রয়েছে।
তালেবানকে হুমকি দেওয়া হয়তো তারই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
তবে বাস্তবতা হলো—দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে ক্ষতি হবে উভয়েরই।
পাকিস্তান এখনো কোটি কোটি আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, এবং সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর উভয় দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল।
তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তানের প্রকাশ্য হুমকি শুধু দুই দেশের নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।
ইস্তাম্বুলে ব্যর্থ শান্তি আলোচনার পর যে ভাষায় পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ সংকেত দিচ্ছে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—দুই মুসলিম প্রতিবেশী কি আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়াবে, নাকি শান্তির পথে ফিরবে?
MAH – 13562 I Signalbd.com



