বিশ্ব

রিওতে মৃতদেহের স্তূপ দেখে আতঙ্ক, এক রাতে নিহত কমপক্ষে ১৩২

Advertisement

ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রক্ত আর আতঙ্কের গন্ধ। মঙ্গলবার রাতে পুলিশের বৃহৎ মাদকবিরোধী অভিযানে অন্তত ১৩২ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় মানবাধিকার দপ্তর। শহরের বিভিন্ন ফ্যাভেলা এলাকায় সড়কে মরদেহের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ঘটনার পর গোটা শহর যেন পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে।

অভিযানের ভয়াবহ রাত: রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মরদেহ

রিও ডি জেনিরোর পেনহা ফ্যাভেলা ও মারে কমপ্লেক্সসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মঙ্গলবার রাতে এই অভিযান চালানো হয়। স্থানীয় সময় রাত ১০টার পর শুরু হয় পুলিশি তৎপরতা, যা টানা পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে। বাসিন্দারা জানান, বন্দুকের গুলির শব্দে শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
মানবাধিকার দপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা গেছে। প্রাথমিকভাবে ৬৪ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হলেও, বুধবার সকালে সংখ্যাটি দ্রুত দ্বিগুণ হয়ে যায়। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষও রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযানের পেছনে ছিল মাদকচক্র ‘কমান্ডো ভার্মেলহো’

ব্রাজিলের কুখ্যাত অপরাধী সংগঠন ‘কমান্ডো ভার্মেলহো’ বা “রেড কমান্ড” বহুদিন ধরে রিওর ফ্যাভেলাগুলোতে মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
সরকারি সূত্র জানায়, প্রায় ২৫০০ পুলিশ সদস্য এই অভিযানে অংশ নেয়। সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে গ্যাংয়ের ঘাঁটিগুলোতে প্রবেশ করা হয়। অভিযানের সময় প্রচুর গুলিবিনিময় ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে ড্রোন থেকে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

জনমনে চরম আতঙ্ক ও ক্ষোভ

অভিযানের পরদিন সকালেই রাস্তায় মরদেহের স্তূপ দেখতে পান স্থানীয়রা। অনেকেই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে এসে লাশের স্তুপে প্রিয়জনদের খুঁজেছেন।
৭০ বছর বয়সী এক নারী বাসিন্দা বলেন, “জীবনে এমন কিছু দেখিনি। আকাশে হেলিকপ্টার, মাটিতে গুলির শব্দ, আর রাস্তাজুড়ে মৃতদেহ — এটা কোনো শহর নয়, যেন যুদ্ধক্ষেত্র।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, পুলিশের এই অভিযান ‘বেপরোয়া ও অমানবিক’। তাঁরা বলছেন, “অপরাধ দমনের নামে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”

সরকারের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

রিওর গভর্নর ক্লাউদিও কাস্ত্রো অভিযানের পর তাঁর এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের পুলিশ অপরাধীদের সঙ্গে আপস করে না। এটি মাদকসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।”
তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলছে, পুলিশি অভিযান চালানোর সময় নাগরিকদের জীবন ও মানবাধিকার রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
ঘটনার সময় শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ ও সি৪০ মেয়র সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছিল। এমন আন্তর্জাতিক আয়োজনের আগমুহূর্তে এই রক্তাক্ত অভিযান বিশ্বমঞ্চে ব্রাজিল সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

রিওতে অতীতেও এমন অভিযান ঘটেছে

এটি রিওতে প্রথম এমন রক্তাক্ত অভিযান নয়। এর আগে ২০২১ সালেও পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে ২৮ জন নিহত হয়েছিলেন। তবে এবার মৃতের সংখ্যা তার বহু গুণ বেশি। স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কঠোর মাদকবিরোধী অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে শহরের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ব্রাজিলে প্রতিবছর গড়ে ৭০০ জন নাগরিক পুলিশি অভিযানে নিহত হন, যা প্রতি দিনে দুইজনেরও বেশি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশটি ধীরে ধীরে এক “পুলিশ রাষ্ট্রে” পরিণত হচ্ছে।

বিশ্লেষণ

ব্রাজিলের সমাজবিজ্ঞানী কার্লোস মন্টালভো মনে করেন, “মাদকবিরোধী অভিযান প্রয়োজনীয় হলেও, রাষ্ট্র যখন সহিংসতার পথে যায়, তখন সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়।”
তিনি আরও বলেন, “যদি আইন প্রয়োগের নামে নিরীহ মানুষ মারা যায়, তবে সেটি আইনের শাসনের পরিপন্থী। দীর্ঘমেয়াদে এই সংস্কৃতি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলবে।”

রিও ডি জেনিরোর সাম্প্রতিক এই অভিযান কেবল একটি শহরের নয়, বরং পুরো লাতিন আমেরিকার নিরাপত্তা বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। অপরাধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান হয়তো প্রশংসনীয়, তবে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি এবং আইনের অপব্যবহার নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে। প্রশ্ন এখন একটাই — নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ব্রাজিল কি আরও ভয়াবহ এক চক্রে প্রবেশ করছে?

এম আর এম – ২০০৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button