অবৈধভাবে কানাডায় অবস্থান ও কর্মসংস্থানকারী ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে দেশটির সরকার সম্প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে দেশজুড়ে চলা অভিবাসন অভিযানে শতাধিক ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়েছে। অনেককেই ইতোমধ্যে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (CBSA)।
এই অভিযানকে বলা হচ্ছে গত কয়েক বছরের মধ্যে কানাডায় পরিচালিত সবচেয়ে বড় ও ব্যাপক অভিবাসন অভিযান।
অভিযানের শুরু ও পরিধি
CBSA-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে এই অভিযান শুরু হয়। প্রথম দফায় ক্যালগারি, টরন্টো ও ভ্যাংকুভার শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। বিশেষত নির্মাণকাজ, রেস্তোরাঁ, কৃষিখামার ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলোতে অবৈধভাবে কাজ করা বিদেশি নাগরিকদের টার্গেট করা হয়।
ক্যালগারির একটি নির্মাণাধীন ভবনে পরিচালিত অভিযানে চারজন অবৈধ কর্মীকে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে তিনজনই ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। CBSA জানিয়েছে, তাদের ভিসার মেয়াদ বহু আগে শেষ হলেও তারা ভুয়া নথি ব্যবহার করে চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন।
সেপ্টেম্বরে টরন্টোর পিল অঞ্চলে আরেকটি অভিযানে ৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় কর্মী শনাক্ত করা হয়। তাদের অধিকাংশই ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা, যারা পড়াশোনা শেষে বৈধ পারমিট ছাড়াই কাজ করছিলেন। অনেকেরই ছাত্র ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা এখনো দেশে ফেরেননি।
কানাডার কড়া সতর্কবার্তা
CBSA জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত ও প্রত্যাবাসনের কাজ আরও জোরদার করা হচ্ছে। এজন্য সংস্থাটিতে এক হাজারের বেশি অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অবৈধ অভিবাসন রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-নির্ভর নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে অভিবাসন নথি যাচাই, ভিসার মেয়াদ পর্যবেক্ষণ ও অবৈধ কর্মসংস্থানের তথ্য দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
CBSA এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“যেসব ব্যক্তি ভিসার শর্ত লঙ্ঘন করে কাজ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যদি অবৈধভাবে অবস্থান করেন, তাদের দেশত্যাগের নির্দেশ বা বহিষ্কারের মুখোমুখি হতে হবে।”
অবৈধ কর্মীদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা
শুধু অভিবাসীরাই নয়, অবৈধভাবে কর্মী নিয়োগকারী নিয়োগকর্তারাও এই অভিযানের আওতায় আসছেন। কানাডার শ্রম আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীন অভিবাসীকে চাকরি দেয়, তবে প্রতিটি লঙ্ঘনের জন্য ৫০ হাজার কানাডীয় ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
এছাড়া বারবার এমন অপরাধে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।
ভারতীয় অভিবাসন প্রবাহ ও সাম্প্রতিক উদ্বেগ
কানাডায় বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও অভিবাসী মিলিয়ে একটি বড় অংশ দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, অনেক ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কানাডায় থেকে যাচ্ছেন। তারা অনেক সময় ছোট ব্যবসা, নির্মাণ খাত বা কৃষিখামারে অবৈধভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে অবৈধভাবে থাকা অভিবাসীরা শুধু দেশের আইন লঙ্ঘন করছেন না, বরং কানাডার শ্রমবাজারেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছেন। এতে স্থানীয় নাগরিকদের চাকরির সুযোগ কমে যাচ্ছে।
কেন বাড়ছে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালের হিসাবে কানাডায় পড়াশোনা করা বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি ভারতীয়।
কিন্তু উচ্চশিক্ষা শেষ করে অনেকেই স্থায়ীভাবে কানাডায় থাকতে চান। তারা চাকরির অনুমতি না পেয়েও অবৈধভাবে থেকে যান।
অর্থনৈতিক কারণে অনেক ভারতীয় পরিবার সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে গিয়ে বিপুল ঋণের বোঝা নেয়। ফলে দেশে ফিরে আসা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এই বাস্তবতা থেকেই অনেকেই অবৈধভাবে কাজ চালিয়ে যান।
ভারত-কানাডা কূটনৈতিক টানাপোড়েনের প্রভাব
কানাডায় অবৈধ ভারতীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান এমন সময়ে চলছে, যখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনপূর্ণ। ২০২৩ সালে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা চলছে।
এর প্রভাব পড়েছে অভিবাসন নীতিতেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় কানাডা সরকার ভারতীয় নাগরিকদের বিষয়ে আরও কঠোর হচ্ছে।
অভিযানে আটক ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ কী?
CBSA জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের প্রত্যেকের মামলার পৃথকভাবে বিচার করা হবে। যাদের বৈধ থাকার সুযোগ নেই, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার আবেদনও করেছেন।
অভিবাসন আইনজীবীরা বলছেন, আটক ব্যক্তিদের অনেকেরই কানাডায় পরিবার বা চাকরি রয়েছে। তারা আপিলের সুযোগ নিতে পারেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আপিল সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ভারতীয় প্রবাসী সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া
কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসী সংগঠনগুলো এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি,
“সব ভারতীয় অভিবাসী অবৈধ নয়। কিছু ব্যক্তির ভুলের কারণে পুরো সম্প্রদায়কে দোষারোপ করা অন্যায়।”
তারা কানাডা সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অভিযানের ব্যাপারে বিবেচনা করা হয়।
কানাডার সরকারী অবস্থান
কানাডার অভিবাসন মন্ত্রী শয়ন ফ্রেজার বলেন,
“আমরা বৈধ অভিবাসীদের স্বাগত জানাই, তবে কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে দেশে থাকে বা কাজ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কানাডা সবসময় আইন ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।”
তিনি আরও বলেন,
“কানাডা বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু অভিবাসন নীতির অপব্যবহার আমরা সহ্য করব না।”
অর্থনৈতিক প্রভাব ও শ্রমবাজারের বাস্তবতা
কানাডা বর্তমানে কর্মী সংকটে ভুগছে, বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ ও স্বাস্থ্য খাতে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে বিদেশি কর্মীদের উপর নির্ভর করছে।
কিন্তু যখন অবৈধ কর্মীরা এই জায়গাগুলো পূরণ করছেন, তখন তা সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি কর রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে কানাডার অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানাডায় বৈধভাবে কাজ করতে হলে শিক্ষার্থী বা অস্থায়ী ভিসাধারীদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করা আবশ্যক। যারা পড়াশোনা শেষে থেকে যেতে চান, তারা Post-Graduate Work Permit (PGWP) বা Permanent Residency (PR)-এর জন্য আবেদন করতে পারেন।
তারা আরও পরামর্শ দেন, অবৈধভাবে অবস্থান করার পরিবর্তে ভারতীয় তরুণরা যদি বৈধ উপায়ে অভিবাসনের চেষ্টা করেন, তবে ভবিষ্যতে তাদের জন্য সুযোগের দরজা আরও বড় হবে।
সার্বিক চিত্র ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, কানাডা সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে এখন “শূন্য সহনশীলতা নীতি” গ্রহণ করেছে। ফলে আগামী মাসগুলোতে আরও অভিযান চালানো হতে পারে।
তবে একইসঙ্গে সরকার বৈধভাবে কাজ ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগও বাড়াতে কাজ করছে। কারণ দেশটির অর্থনীতি অভিবাসী শ্রমিকদের ওপরই নির্ভরশীল।
অবৈধ ভারতীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে কানাডার সাম্প্রতিক অভিযান দেশটির অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং কানাডার শ্রমবাজার, কূটনীতি ও মানবিক দিক—সবকিছুকেই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
এই ঘটনার প্রভাব ভারত-কানাডা সম্পর্কেও পড়তে পারে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—যারা অবৈধভাবে সেখানে রয়েছেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে।
MAH – 13539 I Signalbd.com



