দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও সীমান্ত সংঘাতের পর অবশেষে এক নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে। তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় রাজধানী আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই মুসলিম প্রতিবেশী দেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।
তালেবান সরকারের মুখপাত্র মাওলানা জবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের (Taliban Government) পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য তুরস্কে যাচ্ছে।
এই আলোচনাকে অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে হাজ্জি নাজিব
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জানান, আফগান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাজ্জি নাজিবুল্লাহ। তিনি তালেবান সরকারের একজন প্রভাবশালী ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।
মাওলানা মুজাহিদ বলেন—
“প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাজ্জি নাজিব। কয়েক দিন আগে দোহায় যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ও অগ্রগতির বিষয়গুলো নিয়েই মূলত তুরস্কে আলোচনা হবে।”
এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে দোহা চুক্তির বাস্তবায়ন, সীমান্তে স্থিতিশীলতা, এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো।
সীমান্ত উত্তেজনার পটভূমি
গত কয়েক মাস ধরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বালুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তে বারবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
পাকিস্তান দাবি করছে, আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, কাবুলের তালেবান সরকার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, “পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করবে।”
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও নতুন আলোচনার উদ্দেশ্য
মাওলানা জবিহুল্লাহ মুজাহিদ আরও জানান,
“গত সপ্তাহে সংঘর্ষের পর পাকিস্তান পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এখন তুরস্কের বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।”
এই বৈঠক মূলত যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্থায়ী করার ও দুই দেশের সীমান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামি বিশ্বের এক প্রভাবশালী মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে কাজ করছে। তাই অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তুরস্কের এই উদ্যোগ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিশ্বাস পুনর্গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
তুরস্কের ভূমিকা: মুসলিম বিশ্বের মধ্যস্থতাকারী
তুরস্ক এর আগে সিরিয়া, আজারবাইজান, লিবিয়া এমনকি ইউক্রেন সংকটেও মধ্যস্থতা করেছে। আফগান-পাকিস্তান ইস্যুতেও দেশটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য নিরপেক্ষ মঞ্চ প্রদান করছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন—
“আমরা চাই ইসলামি বিশ্বে কোনো রকম রক্তপাত বা অভ্যন্তরীণ সংঘাত না থাকুক। তুরস্ক সব সময় শান্তি ও সংলাপের পক্ষে।”
এই বক্তব্য প্রমাণ করে, তুরস্ক শুধু রাজনৈতিক কূটনীতিতেই নয়, বরং ইসলামি সংহতির প্রতীক হিসেবেও ভূমিকা রাখতে চায়।
দোহা চুক্তির বাস্তবায়ন: আলোচনার মূল কেন্দ্র
২০২০ সালে দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান সরকারের মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তির আওতায় মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং তালেবান ক্ষমতা গ্রহণ করে।
এখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে যে চুক্তি হয়েছে, সেটিও “দোহা কাঠামো”র ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
তবে বাস্তবায়নের পথে রয়েছে অনেক বাধা—বিশেষত সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য, ও জঙ্গি তৎপরতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো।
তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি হতে পারে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ, চীন, রাশিয়া ও ইরানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এই আলোচনার খবরকে স্বাগত জানিয়েছে।
জাতিসংঘের আফগান বিষয়ক দূত জানান—
“আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে উঠলে সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।”
চীনও জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য রুট ও অবকাঠামো উন্নয়নে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে সহায়তা করতে আগ্রহী।
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা
দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখনো খুব কম। সীমান্তে নিরাপত্তা সমস্যা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক আলোচনা সফল হলে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বাণিজ্য রুট পুনরায় সচল হতে পারে, যা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ বাড়াবে।
বিশেষ করে তোর্খাম ও স্পিন বোলদাক সীমান্তপথ পুনরায় সক্রিয় হলে আমদানি-রপ্তানিতে বড় পরিবর্তন আসবে।
অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পাকিস্তান ও তালেবান
পাকিস্তান সরকার বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। অন্যদিকে, তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে মরিয়া।
তাই দুই দেশই চাইছে এমন একটি সমঝোতা, যা তাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “তুরস্কে এই বৈঠক শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের ভবিষ্যত কূটনীতির দিকনির্দেশনা দিতে পারে।”
পূর্বের বৈঠকগুলোর ফলাফল
এর আগে কাতারের রাজধানী দোহায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে।
তবে বেশিরভাগ সময়ই সেই বৈঠকগুলোতে কোনো চূড়ান্ত সমাধান বা লিখিত চুক্তি হয়নি।
কিন্তু এবার উভয় পক্ষই বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, কারণ সাম্প্রতিক সংঘর্ষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং জনগণের মধ্যে যুদ্ধবিরক্তি দেখা দিয়েছে।
মানবিক সংকটও আলোচনার অংশ
তুরস্কে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে মানবিক ইস্যুও আলোচনায় থাকবে বলে জানা গেছে।
বিশেষ করে আফগান শরণার্থী, সীমান্তপারের বাণিজ্যিক চলাচল, নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
জাতিসংঘের মতে, বর্তমানে পাকিস্তানে প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি আফগান শরণার্থী বসবাস করছে। তাদের অবস্থান নিয়েও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মতবিরোধ চলছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন—
- “তুরস্ক এই আলোচনার মাধ্যমে ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।”
- “যদি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি চুক্তি সফল হয়, তাহলে তা মধ্য এশিয়া, চীন ও ইরানের বাণিজ্য পথ খুলে দেবে।”
- “তালেবান সরকার এই সুযোগে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আরও কাছাকাছি পৌঁছাবে।”
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান—দুই দেশের ইতিহাসে পারস্পরিক সম্পর্কের উত্থান-পতন অনেক পুরনো। কখনো সহযোগিতা, কখনো সংঘাত—এই দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করেছে।
তুরস্কে হতে যাওয়া এই বৈঠক তাই শুধু এক রাজনৈতিক উদ্যোগ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে আঙ্কারার দিকে—দেখা যাক, এই সংলাপ কি সত্যিই দুই মুসলিম প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে কি না।
MAH – 13471 I Signalbd.com



