বিশ্ব

বিদেশি শ্রমিকদের সুখবর দিলো সৌদি আরব

Advertisement

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান: সৌদি আরবে নতুন শ্রম অধ্যায়ের সূচনা

অবশেষে দীর্ঘ ৫০ বছরের পুরনো ‘কাফালা’ বা পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থা বাতিল করেছে সৌদি আরব সরকার। এই সিদ্ধান্তে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি বিদেশি শ্রমিক সরাসরি উপকৃত হবেন বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। দেশটিতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে বড় অংশই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ফিলিপাইন থেকে আগত।

বিশ্বের অন্যতম বড় শ্রমবাজার হিসেবে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো “ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী” বলে অভিহিত করেছে।

কাফালা ব্যবস্থা কী ছিল?

‘কাফালা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘কাফিল’ (كفيل) শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘স্পন্সর’ বা ‘অভিভাবক’।
১৯৫০-এর দশকে উপসাগরীয় দেশগুলো—বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও বাহরাইন—বিদেশি শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের জন্য এই কাফালা ব্যবস্থা চালু করে।

এই ব্যবস্থায় একজন শ্রমিকের আইনি ও পেশাগত মর্যাদা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করত তার স্পন্সর বা কফিলের ওপর।
অর্থাৎ, শ্রমিক কোথায় কাজ করবেন, চাকরি বদলাবেন কি না, দেশ ত্যাগ করতে পারবেন কি না—সবকিছুই নিয়োগকর্তার অনুমতির ওপর নির্ভর করত।

এ ব্যবস্থার কারণে বহু বিদেশি শ্রমিক অত্যাচার, হয়রানি, বেতন না পাওয়া, পাসপোর্ট জব্দ হওয়াচাকরি ছাড়তে না পারার মতো সমস্যায় পড়তেন।

কেন এই ব্যবস্থা বাতিলের প্রয়োজন ছিল?

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালহিউম্যান রাইটস ওয়াচ দীর্ঘদিন ধরে কাফালা ব্যবস্থার বিরোধিতা করে আসছিল। তারা দাবি করে, এই কাঠামো বিদেশি শ্রমিকদের “দাসপ্রথার আধুনিক রূপ” এ পরিণত করেছে।

বিশেষ করে সৌদি আরবে প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন, যাদের অনেকে বছরের পর বছর কষ্টকর ও অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করেছেন।

অন্যদিকে, সৌদি সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার আওতায় শ্রমবাজার সংস্কারে উদ্যোগ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কাফালা ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।

নতুন শ্রম কাঠামোর বৈশিষ্ট্য কী?

সৌদি প্রেস এজেন্সি (SPA) জানিয়েছে, নতুন কাঠামোটি ‘চুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থান মডেল’ নামে চালু করা হয়েছে।
এই মডেলে একজন কর্মী ও তার নিয়োগকর্তার মধ্যে সরাসরি ইলেকট্রনিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যা শ্রমিকের অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে।

নতুন ব্যবস্থায় যা থাকছে:

  1. শ্রমিক তার বর্তমান নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন
  2. এক্সিট ভিসা ছাড়াই দেশ ত্যাগ করা যাবে।
  3. শ্রমিকরা পাবেন আইনি সহায়তা ও সুরক্ষা
  4. নির্ধারিত সময় শেষে শ্রমিক চাইলে চুক্তি নবায়ন বা বাতিল করতে পারবেন।
  5. ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্ম এর মাধ্যমে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, যাতে হয়রানি বা দেরি না হয়।

কারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন?

সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ
এর মধ্যে:

  • বাংলাদেশ: প্রায় ২০ লাখ
  • ভারত: প্রায় ২৫ লাখ
  • পাকিস্তান: প্রায় ২৫ লাখ
  • ফিলিপাইন: প্রায় ১৫ লাখ
  • নেপাল ও শ্রীলঙ্কা: প্রায় ১০ লাখ

এই নতুন আইনে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছেন দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শ্রমিকরা, যারা এতদিন নানা বিধিনিষেধ ও হয়রানির শিকার ছিলেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে,

“এটি সৌদি শ্রম ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। তবে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয়, এর বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।”

অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে,

“এই সংস্কার শ্রমিকদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখবে। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন কোনো বৈষম্য না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”

সৌদি সরকারের বক্তব্য

সৌদি মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ আল-রাজি বলেন,

“আমরা চাই সৌদি আরব হোক দক্ষ ও মানবিক শ্রমবাজারের বিশ্বনেতা। নতুন আইন শ্রমিকদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি বহন করছে।”

তিনি আরও জানান, এই সংস্কারের লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক বিনিয়োগ বাড়ানো, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বিদেশি কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা

বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বড় শ্রম রপ্তানিকারক দেশ।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সৌদি আরবে গিয়েছেন প্রায় ৪ লাখ নতুন বাংলাদেশি শ্রমিক

নতুন কাঠামো কার্যকর হলে তারা আগের তুলনায়:

  • সহজে চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন,
  • বেতন বকেয়া নিয়ে আইনি সহায়তা পাবেন,
  • এবং প্রতারণামূলক নিয়োগ এড়াতে পারবেন।

বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেছেন,

“সৌদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের লাখো শ্রমিকের জন্য স্বস্তির বার্তা। এটি প্রবাসীদের অধিকার রক্ষায় বড় পদক্ষেপ।”

শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা

রিয়াদে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন,

“আগে চাকরি বদলাতে হলে কফিলের অনুমতি লাগত, অনেক সময় তিনি টাকা দাবি করতেন। এখন সেই ঝামেলা থাকবে না—এটা আমাদের জন্য বড় স্বস্তি।”

অন্যদিকে জেদ্দায় থাকা গৃহকর্মী রুবিনা আক্তার বলেন,

“আমরা এখন নিজের ইচ্ছায় নতুন কাজ নিতে পারব। এটা যেন নতুন জীবনের সূচনা।”

ভিশন ২০৩০: সৌদির উন্নয়নের রোডম্যাপ

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এর ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো
“সৌদি আরবকে তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে জ্ঞাননির্ভর ও বৈচিত্র্যময় অর্থনীতিতে রূপান্তর করা।”

এই সংস্কারের মাধ্যমে বিদেশি শ্রমবাজারে সৌদির ভাবমূর্তি আরও উন্নত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

তবে কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন—
নতুন আইন প্রয়োগে যদি প্রশাসনিক দুর্বলতা, কর্মসংস্থানের বৈষম্য বা ভাষাগত বাধা থেকে যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
তাই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) সৌদি সরকারকে মনিটরিং ও রিপোর্টিং প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে।

সৌদি আরবের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত শুধু একটি দেশের শ্রমনীতি পরিবর্তন নয়—
এটি দক্ষিণ এশিয়ার কোটি প্রবাসী শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের এক বিশাল পদক্ষেপ

এই সংস্কারের মাধ্যমে সৌদি আরব দেখিয়ে দিলো, আধুনিক বিশ্বে উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়,
বরং মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায্য শ্রম অধিকার নিশ্চিত করাও তার অপরিহার্য অংশ।

দীর্ঘ ৫০ বছর পর কাফালা ব্যবস্থার অবসান বিশ্ব শ্রমবাজারে এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এখন সময় এসেছে বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সৌদি আরবকে মানবিক শ্রমনীতির আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার।

বাংলাদেশসহ কোটি শ্রমিকের আশা—এই নতুন ব্যবস্থায় তাদের পরিশ্রমের মূল্য আরও বেশি সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃত হবে।

MAH – 13410 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button