
রাশিয়া ও ইরান—দুটি দেশই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও ভূরাজনৈতিক চাপের মুখে এই দুই দেশ ক্রমেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠছে। সোমবার (২১ অক্টোবর) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, “রাশিয়া ইরানের সঙ্গে সবক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণে প্রস্তুত।”
পেসকভ বলেন, “ইরান আমাদের কৌশলগত অংশীদার, এবং আমাদের সম্পর্ক দ্রুত, ইতিবাচক ও বাস্তবমুখীভাবে এগোচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই দুই দেশের ভবিষ্যৎ আরও শক্তিশালী হবে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে অযথা চাপ সৃষ্টি করছে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। পেসকভের ভাষায়, “পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ওপর যে অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছে, তা কেবল আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং আলোচনার পরিবেশকেও নষ্ট করছে।”
রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
গত এক দশকে রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মস্কো যখন পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে, তখন ইরান তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে এগিয়ে আসে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এক ঐতিহাসিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যদিও চুক্তিতে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা বিষয়ক কোনো ধারা নেই, তবে অর্থনীতি, জ্বালানি, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এতে অগ্রাধিকার পেয়েছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ ঘোষণা দেয় যে, তারা পরস্পরের সঙ্গে “দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে” সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বিশেষ করে তেল, গ্যাস, পারমাণবিক জ্বালানি, পরিবহন ও প্রতিরক্ষা খাতে যৌথ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়।
তেহরানে রুশ দূতের সফর: কৌশলগত বার্তা
সোমবারই রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের এক বিশেষ দূত তেহরানে পৌঁছান। তিনি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলি লারিজানির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, এই বৈঠকে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে, আলি লারিজানি নিজে মস্কো সফরে গিয়ে পুতিনের হাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বার্তা পৌঁছে দেন। এই ধারাবাহিক যোগাযোগ দুই দেশের নেতৃত্বের মধ্যে আস্থার সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলছে।
ইরানকে রাশিয়ার সমর্থন ও পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া অতীতেও ইরানের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে মস্কো তীব্র নিন্দা জানায়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন জানায়, “যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ইরানের প্রতি সামরিক আগ্রাসন অঞ্চলজুড়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে।”
ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত, এবং তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না। তবে পশ্চিমা দেশগুলো সেই দাবি মেনে নিতে নারাজ।
রাশিয়া মনে করে, ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা উচিত, চাপ বা হুমকির মাধ্যমে নয়। এই অবস্থানই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইরানের ভূমিকা
রাশিয়া–ইরান সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ইরান রাশিয়াকে শত শত যুদ্ধ ড্রোন সরবরাহ করেছে, যা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও স্বীকার করেছে যে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে “প্রযুক্তিগত সহযোগিতা” বজায় রেখেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া বলছে, ইরান থেকে প্রাপ্ত ড্রোন আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই সহযোগিতা রাশিয়াকে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, সামরিক প্রযুক্তিতেও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। পাশাপাশি ইরানও রাশিয়ার মাধ্যমে উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পারমাণবিক জ্বালানি খাতে বিশাল চুক্তি
গত মাসে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা রোসাটম ইরানের সঙ্গে ২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির আওতায় ইরানে চারটি নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটে থাকা ইরানের একমাত্র কার্যকর পারমাণবিক কেন্দ্রটি বুশেহর শহরে অবস্থিত, যা রাশিয়ার প্রকৌশলীরা নির্মাণ করেছিলেন। নতুন কেন্দ্রগুলো নির্মিত হলে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
রোসাটম জানিয়েছে, এসব প্রকল্পে রাশিয়ান প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ ব্যবহার করা হবে। এতে ইরান শুধু জ্বালানি ক্ষেত্রে নয়, প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতাতেও এগিয়ে যাবে।
বাণিজ্য, অর্থনীতি ও পরিবহন সহযোগিতা
রাশিয়া ও ইরান ইতিমধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রুশ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ।
দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংযোগ সড়ক হিসেবে ইরান এখন রাশিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নর্থ–সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর প্রকল্পের মাধ্যমে রাশিয়া ইরানের বন্দর ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাতে চায়।
এই করিডর চালু হলে মস্কো–তেহরান–মুম্বাই বাণিজ্য রুট সক্রিয় হবে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
আঞ্চলিক কূটনীতি ও নতুন ভারসাম্য
রাশিয়া ও ইরান—উভয় দেশই মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় ভূমিকা রাখছে। সিরিয়া সংকটে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করেছে, যেখানে তারা বাশার আল-আসাদের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সামরিক সহায়তা দেয়।
তাছাড়া, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতেও রাশিয়া ও ইরানের অবস্থান প্রায় একই। উভয় দেশই পশ্চিমা সামরিক জোটের বিপরীতে “বিকল্প শক্তি” হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘনিষ্ঠতা শুধু কৌশলগত নয়, এটি এক নতুন ভূরাজনৈতিক জোটের ইঙ্গিতও বহন করছে। তারা বলছেন, মস্কো ও তেহরান এখন এমন এক “পারস্পরিক নির্ভরশীল সম্পর্ক” গড়ে তুলছে, যা আগামী দশকেও প্রভাব ফেলবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ইরানের অর্থনীতি এখনও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ভারে ন্যুব্জ, এবং রাশিয়ারও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে।
তবে উভয় দেশই বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থায় কাজ করছে। তারা ডলার নির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উদ্যোগ সফল হলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারে।
রাশিয়া বিশ্বাস করে, ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিরও পথ খুলে দেবে। আর ইরানের জন্য রাশিয়া হলো এমন এক বন্ধু, যিনি পশ্চিমা চাপের বিরুদ্ধে পাশে দাঁড়াতে সক্ষম।
বিশ্লেষণ
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাশিয়া–ইরান সম্পর্ক শুধু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং এটি এক নতুন যুগের সূচনা। যখন পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক জোটের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চায়, তখন মস্কো ও তেহরান বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।
রাশিয়া এখন স্পষ্টভাবে বলছে—ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে তারা প্রস্তুত, এবং সেই সম্পর্ক হবে জ্বালানি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা–সব ক্ষেত্রে সমানভাবে বিস্তৃত।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সম্পর্ক যত গভীর হবে, ততই পরিবর্তন আসবে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে।
MAH – 13404 I Signalbd.com