
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও গণতন্ত্র রক্ষার ডাক উঠেছে। দেশজুড়ে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। “নো কিংস” নামে এই দেশব্যাপী আন্দোলনে নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসি, মায়ামি—সব শহরেই মানুষের ঢল নেমেছে। আন্দোলনের মূল স্লোগান একটাই— আমেরিকায় রাজা নয়, গণতন্ত্র চলবে।
আন্দোলনের সূচনা ও ব্যাপ্তি
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সকাল থেকেই নিউইয়র্কের বিখ্যাত টাইমস স্কোয়ারে ভিড় জমতে থাকে। ঘণ্টা দু’য়ের মধ্যেই সেখানে কয়েক হাজার মানুষ প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন। এরপর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই “নো কিংস” আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়।
শুধু বড় শহর নয়, ছোট শহর ও কলেজ টাউনগুলোতেও মানুষ নেমে আসে। তরুণ প্রজন্ম, নারী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরাও বিক্ষোভে অংশ নেন।
বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল নানা বার্তায় লেখা পোস্টার—
- “গণতন্ত্র বিক্রি করা যাবে না”
- “আমাদের সংবিধান কোনো খেলনা নয়”
- “আমেরিকায় কোনো রাজা নেই”
এই স্লোগানগুলো দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে #NoKings আন্দোলন ঘিরে ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে।
শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ় অবস্থান
আয়োজকরা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই আন্দোলন হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। তাদের সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হয়, “আমরা বিশ্বাস করি, শক্তির ব্যবহার নয়, একতার মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব।”
এ কারণে সারাদিনের কর্মসূচিতে কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (NYPD) জানায়, শুধুমাত্র নিউইয়র্কেই এক লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত বড় সমাবেশেও কোনো গ্রেপ্তার বা সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্ব করছেন।
তিনি বেশ কিছু ফেডারেল তহবিল স্থগিত করেছেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে নিজস্ব অনুগতদের নিয়োগ দিচ্ছেন, এবং কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন গভর্নরদের অনুমতি ছাড়াই।
অর্থনীতিতেও তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্যনীতিতে বিদেশি পণ্যের ওপর বাড়ানো হয়েছে শুল্ক, যার ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে।
এছাড়া, অভিবাসন আইন আরও কঠোর করায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিরোধীদের অভিযোগ ও সরকারের অবস্থান
ট্রাম্পের সমর্থকরা এই আন্দোলনকে “হেইট আমেরিকা র্যালি” আখ্যা দিয়েছেন। তাদের দাবি, এই আন্দোলনে বামপন্থী গোষ্ঠী অ্যান্টিফা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে এবং তারা দেশকে বিভাজিত করতে চাইছে।
তবে আন্দোলনের আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, এটি কোনো দলীয় বা মতাদর্শিক আন্দোলন নয়।
এটি গণতন্ত্র রক্ষার একটি আহ্বান। আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক লিসা রামিরেজ বলেন,
“আমরা কোনো দলের জন্য নয়, দেশের জন্য মাঠে নেমেছি। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা এমন একটি আমেরিকায় বড় হোক, যেখানে আইনের শাসন সবার জন্য সমান।”
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন,
“আমি একনায়ক নই, আমি জনগণের নির্বাচিত নেতা। যারা ভিন্নমত পোষণ করেন, তারা বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত।”
তিনি আরও বলেন, তার নীতি “আমেরিকাকে পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়”, এবং যারা সমালোচনা করছেন তারা “দেশবিরোধী গোষ্ঠীর অংশ।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে “নো কিংস” আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় নাগরিক জাগরণ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এলিস বলেন,
“আমেরিকার গণতন্ত্রের মূল চেতনা হলো ক্ষমতার ভারসাম্য। প্রেসিডেন্ট যদি সবকিছু নিজের হাতে নিতে চান, তাহলে সেটি বিপজ্জনক বার্তা।”
অনেকে ১৯৭০-এর দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে এই বিক্ষোভের তুলনা করছেন। তখনও তরুণ সমাজ রাস্তায় নেমে সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছিল।
এখন আবার তরুণরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন এক গণতন্ত্র আন্দোলনের।
গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই আন্দোলনকে “গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকেই “ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে” ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তিনি নিয়মিতভাবে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে এক্সিকিউটিভ অর্ডার জারি করছেন, যা আমেরিকার সংবিধানিক ভারসাম্যের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে,
“ট্রাম্পের প্রতিটি সিদ্ধান্তে মনে হয়, তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট নয়, বরং রাজা হিসেবে দেখতে চান।”
অন্যদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে,
“নো কিংস আন্দোলন আমেরিকাকে মনে করিয়ে দিয়েছে— এই দেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেই।”
জনগণের আশা ও ভবিষ্যৎ
বিক্ষোভকারীদের আশা, এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন চিন্তার জন্ম দেবে।
তারা চায়— গণতন্ত্রের মূল চেতনা, মানবাধিকার ও সংবিধানিক ভারসাম্য আবারও প্রতিষ্ঠিত হোক।
অনেক তরুণ বলেছেন, তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান যাতে ভবিষ্যতে এমন শাসনব্যবস্থা আর না গড়ে ওঠে।
কলেজছাত্রী জেসিকা মুর বলেন,
“আমরা রাজনীতি নিয়ে ক্লান্ত, কিন্তু দেশকে ভালোবাসি। তাই আজ আমরা রাস্তায়।”
“নো কিংস” আন্দোলন হয়তো কেবল একটি দিনের বিক্ষোভ নয়— এটি আমেরিকান সমাজে গভীর বার্তা রেখে গেছে।
যে দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সেই দেশে যদি আবার কেউ রাজা হতে চায়, জনগণ তা কখনো মেনে নেবে না— এই সত্যটাই আবার মনে করিয়ে দিয়েছে এই আন্দোলন।
গণতন্ত্রের স্বার্থে, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষায়, এবং নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশে “নো কিংস” আন্দোলন হয়ে উঠেছে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা।
MAH – 13378 I Signalbd.com