দীর্ঘ উত্তেজনা ও সংঘাতের পর অবশেষে ফের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে দুই দেশের প্রতিনিধি দল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে কাতার ও তুরস্ক।
এই বৈঠকের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দুই মুসলিম প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন করে শান্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুই দেশের সীমান্তে যে সহিংসতা, বিমান হামলা ও পারস্পরিক দোষারোপ চলছিল, তা এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। দোহায় হওয়া আলোচনায় দুই পক্ষই জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকবে না—বরং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে উভয় দেশই পরবর্তী বৈঠক চালিয়ে যাবে।
সাম্প্রতিক সংঘাতের পটভূমি
গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে বারবার সংঘর্ষ হয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, আফগানিস্তান থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। অপরদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বলছে, পাকিস্তান সীমান্তে অকারণে হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গত সপ্তাহেই দুই দেশের মধ্যে ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সমঝোতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর একাধিক হামলায় আফগান সীমান্তবর্তী প্রদেশ নানগারহার ও কুনারে অন্তত ১৮ জন নিহত হন বলে দাবি করে কাবুল প্রশাসন। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হয়।
দোহা বৈঠকের মধ্যস্থতায় কাতার ও তুরস্ক
দোহায় অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল দুই দেশের মধ্যে গত কয়েক মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগ। এতে উপস্থিত ছিলেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-থানি, তুরস্কের বিশেষ প্রতিনিধি এমরাহ কুতলু, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সাইয়েদ হায়দার শাহ এবং আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।
বৈঠকে কাতার ও তুরস্ক উভয় দেশই দুই পক্ষকে সংযম ও আস্থার পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানায়। কাতারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জন্য নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা
নতুন যুদ্ধবিরতির আওতায় দুই দেশ একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা বা সীমান্তে গুলি চালানো থেকে বিরত থাকবে। উভয় দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় বাণিজ্য ও যাতায়াত পুনরায় চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
কাতার জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে একটি যৌথ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে কাতার, তুরস্ক, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি যদিও ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে তা স্থায়ী হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতভেদ বিদ্যমান।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “দোহা চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে দুই দেশের আন্তরিকতা ও সীমান্তে কার্যকর নজরদারির ওপর। যদি উভয় পক্ষ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের শান্তির কথা চিন্তা করে, তবে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।”
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে পাকিস্তান জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। ফলে সীমান্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে আর্থিকভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই কারণেও পাকিস্তান সরকার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ জানিয়েছেন, তার সরকার শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা চাই আফগানিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে। যুদ্ধ নয়, উন্নয়নই হোক দুই দেশের লক্ষ্য।”
আফগানিস্তানের অবস্থান
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এই যুদ্ধবিরতিকে ‘আল্লাহর রহমত’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বলেছেন, “আমরা চাই না কোনো মুসলিম দেশ একে অপরের রক্ত ঝরাক। শান্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।”
তালেবান নেতৃত্ব আরও জানায়, তারা সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা দমন করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব
এই যুদ্ধবিরতির প্রভাব শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভারত, ইরান ও চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও ঘটনাটির দিকে নজর রাখছে। বিশেষ করে চীন, যারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণ সংলাপই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সফল বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের শান্তি অপরিহার্য।”
মানবিক পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা
দীর্ঘদিনের সংঘাতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যসংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
কুনারের এক বাসিন্দা ফারিদুল্লাহ বলেন, “আমরা প্রতিদিন ভয় নিয়ে বেঁচে আছি। কখন বিমান হামলা হবে, কখন গুলি শুরু হবে—কেউ জানে না। এখন যদি সত্যিই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তবে আমরা হয়তো আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব।”
জাতিসংঘও এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং দ্রুত মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর আশ্বাস দিয়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও সীমান্তের নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন, শরণার্থী সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা—এই চারটি বিষয় এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। কূটনৈতিক মহল বলছে, যদি এই বিষয়গুলোতে উভয় দেশ আন্তরিকভাবে কাজ করে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন শান্তির অধ্যায় শুরু হতে পারে।
তবে ইতিহাস বলে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক সবসময় জটিল ছিল। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক তালেবান শাসন পর্যন্ত—দুই দেশের মধ্যে কখনোই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই এবারের যুদ্ধবিরতিও কতদিন টিকবে, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান।
দোহা বৈঠকে অর্জিত এই নতুন যুদ্ধবিরতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় দুই মুসলিম দেশের এই উদ্যোগ বিশ্বে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এখন সময়ই বলে দেবে—এটি কেবল সাময়িক বিরতি, না কি সত্যিকার অর্থেই স্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
MAH – 13371 I Signalbd.com



