
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী ও ঐতিহাসিকভাবে জটিল সম্পর্কের দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান তাদের চলমান যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়িয়েছে। কাতারের রাজধানী দোহায় আজ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের শান্তি সংলাপ, যা চলবে উভয় পক্ষের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে। এই সংলাপ চলাকালীন সময় পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বহাল থাকবে, জানিয়েছে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দোহা আলোচনায় নতুন আশার আলো
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, পাকিস্তানের সরকারি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে দোহায় পৌঁছেছে। আফগান প্রতিনিধিরা শনিবার সেখানে যোগ দেন। আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কাতার দীর্ঘদিন ধরেই আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। এবারও দেশটি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আলোচনার স্থান করে দিয়েছে।
দোহা সংলাপের অন্যতম লক্ষ্য হলো— সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাত ও সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপে পারস্পরিক সমঝোতা গড়ে তোলা, যাতে করে ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল পথে এগোয়।
সংঘাতের সূত্রপাত: পুরনো অবিশ্বাসের ইতিহাস
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান সরকার আফগানিস্তানে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ইসলামাবাদ–কাবুল সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। পাকিস্তান শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে, আফগান তালেবান সরকার পাকিস্তানি তালেবান (টিটিপি)-কে আশ্রয় ও সমর্থন দিচ্ছে।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) হলো এমন এক সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামি শাসন কায়েমের লক্ষ্যে বহু বছর ধরে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান সরকার বহু বছর আগে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কাবুলে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে টিটিপি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে, বিশেষত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে, যা আফগান সীমান্তঘেঁষা এলাকা।
এই অঞ্চলে প্রায়ই টিটিপি ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ ঘটে। গত এক বছরে এসব সংঘাতে শত শত প্রাণহানি ঘটেছে।
সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও বিমান হামলা
গত ৯ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাবুলে একটি বৃহৎ বিমান অভিযান চালায়, যেখানে নিহত হন টিটিপির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ এবং তার সহযোগী ক্বারি সাইফুল্লাহ মেহসুদসহ আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
এই হামলার পর পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১১ অক্টোবর আফগান সেনারা খাইবার পাখতুনখোয়ার সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালায়। পাকিস্তানও জবাব দেয় শক্ত হাতে।
সংঘাত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলে, এবং পাকিস্তানের সামরিক তথ্য দপ্তর (আইএসপিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, তাতে আফগান সেনার দুই শতাধিক সদস্য এবং পাকিস্তানের ২৩ জন সেনা নিহত হন।
চার দিনব্যাপী এই সংঘর্ষের পর উভয় দেশ ১৫ অক্টোবর ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। তবে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই পাকিস্তানি সেনারা আবার কান্দাহার ও পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা চালায়, যাতে নিহত হয় ৫০ জনেরও বেশি, আহত হয় ১৫০ জনের মতো মানুষ।
এমন রক্তক্ষয়ের মধ্যেই শেষমেশ কাবুল ও ইসলামাবাদ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়।
কূটনৈতিক অচলাবস্থা: কারো প্রতি কারো আস্থা নেই
আফগান তালেবান সরকার সব সময় দাবি করে আসছে যে, তারা টিটিপিকে সরকারি সমর্থন দেয় না। অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, আফগানিস্তান টিটিপিকে শুধু আশ্রয়ই নয়, অস্ত্র ও অর্থায়নও দিচ্ছে, যা তাদের দেশের নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করছে।
এই পারস্পরিক অভিযোগে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। কূটনৈতিক মহলের মতে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।
দোহা সংলাপ: কূটনীতির নতুন সুযোগ?
দোহায় শুরু হওয়া এই সংলাপ অনেক আন্তর্জাতিক মহলে আশার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এর আগে ২০২১ সালে এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি হয়েছিল।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার এই সংলাপ যদি সফল হয়, তাহলে তা শুধু এই দুই দেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা ও বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্যও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
আলোচনার অন্যতম এজেন্ডা হলো:
- সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা,
- টিটিপি সন্ত্রাস দমন নিয়ে সমঝোতা,
- মানবিক সহায়তা বিনিময়,
- বাণিজ্যিক রুট পুনরায় চালু করা,
- এবং ভবিষ্যতে পারস্পরিক গোয়েন্দা সহযোগিতা গড়ে তোলা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই এই যুদ্ধবিরতি ও শান্তি সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন,
“দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সংলাপই একমাত্র পথ।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও কাতারের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছে, “দোহা শান্তি সংলাপ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।”
পাকিস্তান–আফগান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি এখনো অনেকটা দূরের পথ। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি, নারীর অধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ, এবং টিটিপির ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড—এসব বিষয় পাকিস্তানের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তান মনে করে পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করছে। ফলে সীমান্ত ও নিরাপত্তা ইস্যুতে অবিশ্বাস এখনো গভীর।
তবে দোহা সংলাপ সফল হলে এটি হতে পারে দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের একটি নতুন সূচনা। যুদ্ধবিরতি যদি স্থায়ী হয়, তাহলে সীমান্ত বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তা আবারও সচল হতে পারে—যা দুই দেশের জনগণের জন্যও স্বস্তির খবর হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির জন্য আশার আলো
আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তান–আফগান যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় ইতিবাচক সংকেত। কারণ, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা সরাসরি প্রভাব ফেলে পাকিস্তান, ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ওপর।
যদি দোহা সংলাপ থেকে বাস্তব ফল আসে, তাহলে ভবিষ্যতে চীন, রাশিয়া ও ইরানকেও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হতে পারে, যা পুরো অঞ্চলের জন্য একটি স্থায়ী শান্তির কাঠামো তৈরি করবে।
জনগণের প্রত্যাশা: যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই
দুই দেশের সাধারণ জনগণ বহুদিন ধরেই সংঘাত ও সহিংসতার শিকার। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে জীবনের মান ভয়াবহভাবে নিচে নেমেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার—সবকিছুই যুদ্ধের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বাসিন্দা আমির খান বলেন,
“আমরা আর যুদ্ধ চাই না। আমাদের সন্তানদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা চাই।”
আফগানিস্তানের কান্দাহারের নারী সমাজকর্মী ফাতিমা রশিদ বলেন,
“যদি শান্তি আসে, তাহলে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। দোহা আলোচনায় যেন সত্যিই কিছু ভালো ফল আসে।”
শান্তির পথে নতুন অধ্যায়?
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ইতিহাসে বহুবার সংঘাতে জড়িয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে, শেষ পর্যন্ত সংলাপের টেবিলেই সমাধানের পথ খুঁজতে হয়েছে। দোহা আলোচনাও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
বর্তমান যুদ্ধবিরতি যদি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে, তবে তা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও কাতারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, এই প্রক্রিয়াকে সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অবশেষে বলা যায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পারস্পরিক আস্থা পুনর্গঠন করতে পারে, তাহলে যুদ্ধের আগুন নিভে গিয়ে শান্তির শীতল হাওয়া বইবে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়।
MAH – 13352 I Signalbd.com