হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো সেকশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট জরুরি ভিত্তিতে সিলেটে অবতরণ করেছে। শনিবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণ করে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, আগুন লাগার পরপরই শাহজালাল বিমানবন্দরে সব ধরনের অবতরণ ও উড্ডয়ন সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে আকাশে থাকা একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে বিকল্প বিমানবন্দরে নামতে হয়।
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত দুপুর আড়াইটায়
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনের পাশে একটি অংশে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘন ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ঢেকে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রাথমিকভাবে ১৬টি ইউনিট কাজ শুরু করে। পরে পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় আরও ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যোগ দেয়। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করছেন।
এক পর্যায়ে কার্গো এলাকায় থাকা কর্মচারী, নিরাপত্তাকর্মী ও শ্রমিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিমানবন্দর এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে।
আগুন লাগার কারণ এখনো নিশ্চিত নয়
বিমানবন্দর নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ জানিয়েছেন, আগুন লাগার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
তিনি বলেন, “কার্গো সেকশনের যে অংশে আগুন লেগেছে, সেখানে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য মজুদ ছিল। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসে দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু করে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।”
তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
রিয়াদ থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট সিলেটে অবতরণ
ঘটনার পরপরই আকাশে থাকা কয়েকটি ফ্লাইটকে নিরাপত্তার কারণে বিকল্প রুটে ডাইভার্ট করা হয়। এর মধ্যে রিয়াদ থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইটকে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামানো হয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করেছে এবং যাত্রীদের কেউ আহত হননি। ফ্লাইটের যাত্রীদের সাময়িকভাবে বিমানবন্দরের টার্মিনালে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফ্লাইটটি আবার ঢাকায় নিয়ে আসা হবে।
একজন যাত্রী বলেন, “আমরা ঢাকায় নামার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু পাইলট হঠাৎ ঘোষণা দেন যে, শাহজালালে আগুন লেগেছে, তাই আমরা সিলেটে নামব। প্রথমে একটু ভয় পেলেও সিলেটে নিরাপদে নামতে পেরে স্বস্তি পেয়েছি।”
ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণ অভিযান অব্যাহত
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (অপারেশন) জানান, আগুনের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে কাজ করছেন। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, “আমরা আগুনের উৎস চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। কার্গো সেকশনের কিছু অংশে এখনো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। আগুন যাতে আবার জ্বলে না ওঠে, সেজন্য আমরা পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি।”
ফ্লাইট চলাচল আংশিকভাবে বন্ধ
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শাহজালাল বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। পরে পরিস্থিতি আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসলে কিছু ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়া হয়।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জরুরি অবস্থার কারণে একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে চট্টগ্রাম ও কলকাতায় ডাইভার্ট করা হয়েছে। বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার ও নেভিগেশন ব্যবস্থা আপাতত নিরাপদে রয়েছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “আগুন মূল টার্মিনাল থেকে কিছুটা দূরে, তাই যাত্রীদের সরাসরি ক্ষতির ঝুঁকি ছিল না। তবে ধোঁয়ার কারণে ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হয়।”
পূর্বে এমন ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় নিরাপত্তা ও অগ্নি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। ২০১৯ সালে একই এলাকায় একটি ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, তখনও বৈদ্যুতিক ত্রুটি দায়ী বলে জানা যায়।
তবে এবারের আগুনটি তুলনামূলক ভয়াবহ, কারণ এতে কার্গো ঘরে সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ পণ্য ও কাগজপত্র ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা বড় কারণ
বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানবন্দরের পুরনো অবকাঠামো, অতিরিক্ত লোড ও অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এই ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
একজন বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, “কার্গো এলাকায় স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম ব্যবস্থা এবং অগ্নি সতর্কীকরণ সিস্টেম থাকলেও তা অনেক সময় অকার্যকর থাকে। এখন সময় এসেছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত সংস্কার আনার।”
তদন্তের অপেক্ষায় দেশ
ঘটনার পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগুনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ফায়ার সার্ভিসও আলাদা করে কারণ অনুসন্ধান করবে।
এ ঘটনায় সাময়িকভাবে বিমান চলাচল ব্যাহত হলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে এই অগ্নিকাণ্ড দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
তদন্তে আগুনের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এম আর এম – ১৮২২,Signalbd.com



