বানিজ্য

ভারতীয় সুতা আমদানি: বিধিনিষেধের পরও প্রবাহ কমছে না কেন?

Advertisement

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এ শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হলো সুতা। দেশে ৫০০-র বেশি স্পিনিং মিল বা সুতাকল থাকলেও চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সুতা আমদানি করতে হয়। এর বড় অংশ আসে ভারত থেকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও এর প্রভাব খুব একটা পড়েনি। কারণ সমুদ্রপথে এখনো প্রচুর সুতা আসছে ভারত থেকে।

স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো?

বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মার্চের শেষের দিকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর ১৫ এপ্রিল থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারীসহ দেশের সব স্থলবন্দরে এ আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল অনিয়ম, মিথ্যা ঘোষণা এবং কম দামে দামি সুতা আনা।

বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল—অনেক আমদানিকারক স্থলবন্দরের দুর্বল তদারকির সুযোগ নিয়ে ঘোষণার চেয়ে বেশি ও মানসম্মত সুতা আনতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ৩০ কাউন্টের সুতার সঙ্গে ৮০ কাউন্টের সূক্ষ্ম সুতা গোপনে ঢুকিয়ে আনা হতো। পরে এগুলো স্থানীয় বাজারে কম দামে বিক্রি করতেন অসাধু ব্যবসায়ী। এতে দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে।

বস্ত্রকল মালিকদের মতে, স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আসার সময় কড়াকড়ি না থাকায় এসব অনিয়ম বাড়ছিল। তাই তারা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা চেয়ে আসছিলেন।

বিধিনিষেধের পর আমদানির চিত্র কেমন?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধের পর প্রথম দিকে সুতা আমদানিতে কিছুটা হ্রাস দেখা গেলেও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।

  • আগে: প্রতি মাসে গড়ে ৫ কোটি কেজি সুতা আমদানি হতো ভারত থেকে।
  • বিধিনিষেধের পর: মে ও জুন মাসে তা নেমে আসে গড়ে ৪ কোটি কেজিতে।
  • জুলাই: আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৩৪ লাখ কেজি।

অর্থাৎ সাময়িক প্রভাব পড়লেও আবার আমদানি বেড়েছে সমুদ্রবন্দর দিয়ে। এর মানে হলো, স্থলবন্দর বন্ধ হলেও ভারতীয় সুতার ওপর নির্ভরতা কমেনি।

কেন সমুদ্রবন্দরের পথে আমদানি বাড়ছে?

স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আনা সহজ ও দ্রুত ছিল। আগে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা অর্ডার পাওয়ার দুই দিনের মধ্যে সীমান্তে পণ্য পাঠিয়ে দিতেন। ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে পোশাক কারখানাগুলো সুতা পেত।
কিন্তু এখন সমুদ্রপথে আমদানি করতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগছে। যদিও খরচ কিছুটা কম।

তবুও বাংলাদেশি পোশাকশিল্পীরা সময় বেশি লাগলেও সমুদ্রপথে ভারতীয় সুতা আনতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ ভারতীয় সুতার দাম দেশীয় সুতার তুলনায় কম।

দামের পার্থক্য কত?

বিকেএমইএর (বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন—
“আমার প্রতিষ্ঠানের একটি অর্ডারের জন্য ভারত থেকে যে সুতা ২ ডলার ১২ সেন্টে এনেছি, সেটি বাংলাদেশ থেকে কিনতে ২ ডলার ৬৫ সেন্ট খরচ হতো।”

অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ৫০ সেন্ট পর্যন্ত বেশি খরচ হয় দেশীয় সুতা কিনলে। এই কারণেই ভারতীয় সুতার ওপর নির্ভরশীলতা বেশি।

ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ কত?

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী—

  • জানুয়ারি-জুলাই ২০২৫: ৭২ কোটি কেজি সুতা আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে।
  • এর মধ্যে: ভারত থেকে এসেছে প্রায় ৪৭% বা ৩৪ কোটি কেজি।
  • চীন থেকে এসেছে: ৩৮% বা ২৭ কোটি ৬১ লাখ কেজি।

অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক সুতা ভারত থেকে আমদানি হয়।

ভারত কেন এত বড় বাজার দখল করেছে?

ভারতের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট অঞ্চলগুলো থেকে বাংলাদেশে সুতা আসে।
প্রধান কারণগুলো হলো—
দাম কম (কারণ ভারত সরকার তাদের ব্যবসায়ীদের নগদ সহায়তা দেয়)।
সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত।
মানের দিক থেকে প্রতিযোগিতামূলক।

দেশীয় স্পিনিং মিলের অবস্থা কেমন?

বিটিএমএর (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন) তথ্যমতে—

  • দেশে বর্তমানে ৫১৯টি স্পিনিং মিল রয়েছে।
  • এ মিলগুলো নিট কাপড়ের ৮৫-৯০% এবং ওভেন কাপড়ের প্রায় ৪০% সুতা সরবরাহ করে।
    তবে তারা নানা সংকটে আছে—
  • গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে।
  • গ্যাসের সরবরাহ সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
  • ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে দেশীয় সুতার দামও বেশি হয়েছে।

বাজারে কী প্রভাব পড়েছে?

স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের পর বেশি কাউন্টের সূক্ষ্ম সুতা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এতে দেশীয় স্পিনিং মিলের বিক্রি বেড়েছে। তবে পুরো চাহিদা মেটাতে তারা সক্ষম নয়।
অন্যদিকে, সমুদ্রপথে ভারতীয় সুতা আমদানির কারণে দেশীয় মিলগুলো পুরোপুরি সুবিধা পায়নি।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কী?

শুধু স্থলবন্দর বন্ধ করলেই সমাধান আসবে না। সমুদ্রবন্দরেও কড়াকড়ি দরকার।
আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।
গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট সমাধান করতে হবে।
ভারতীয় সুতার দাম প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণে দেশীয় শিল্প রক্ষায় নীতি সহায়তা দরকার।

পোশাকশিল্পের দাবি কী?

পোশাকশিল্প মালিকরা মনে করেন—
“তাদের না জানিয়ে শুধু বস্ত্রকল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।”
কারণ সুতা আমদানির বিষয়টি সরাসরি পোশাকশিল্পের রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এই শিল্পের জন্য সুতার চাহিদা বিশাল। দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো গেলেও এখনো আমদানির ওপর নির্ভরতা অনেক। ভারতীয় সুতার দাম ও সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ এখনো ভারতের ওপর নির্ভরশীল। স্থলবন্দর বন্ধের পরও সমুদ্রপথে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় স্পষ্ট হয়েছে, কেবল বিধিনিষেধ দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন সমন্বিত নীতি, দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ।

MAH – 12437 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button