
মেক্সিকোতে টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও দুটি শক্তিশালী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের আঘাতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে দেশটির সরকার।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বাস্তব মৃতের সংখ্যা ৪৮ জনের কাছাকাছি হতে পারে।
সরকারি তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভেরাক্রুজ রাজ্য। এখানেই মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৮ জনের। এছাড়া হিডালগো, পুয়েবলা, কুয়েরেতারো ও সান লুইস পোতোসি রাজ্যেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
দুটি ঝড়ের সম্মিলিত আঘাতে সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতি
মেক্সিকোর জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, গত ৬ অক্টোবর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশজুড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়।
এর পেছনে দায়ী দুটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় — ‘প্রিসিলা’ (Priscilla) ও ‘রেমন্ড’ (Raymond)।
এই দুটি ঝড়ের সম্মিলিত প্রভাবে মেক্সিকোর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে টানা তিনদিনের মধ্যে ৫৪০ মিলিমিটার বা ২১ ইঞ্চিরও বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
বৃষ্টির পরই পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ভূমিধস শুরু হয়, নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে ঢুকে পড়ে।
অল্প সময়ের মধ্যেই শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়, বহু ঘরবাড়ি ও সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত গ্রাম, ক্ষতিগ্রস্ত ১৬ হাজারের বেশি বাড়ি
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে, শতাধিক স্কুল ও হাসপাতাল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, তবে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
মেক্সিকোর সামাজিক সুরক্ষা সংস্থা (IMSS) জানিয়েছে, বন্যায় বিপর্যস্ত এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে।
ফলে দুর্যোগের পর দেখা দিয়েছে জলবাহিত রোগের আশঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন তিন লাখের বেশি মানুষ
বন্যা ও ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
সরকারের হিসাবে, প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন।
ভেরাক্রুজ, হিডালগো ও পুয়েবলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ খুঁটি উপড়ে পড়েছে এবং সাবস্টেশন ডুবে গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ পুনরায় চালু করার কাজ চলছে, তবে এতে সময় লাগবে অন্তত আরও কয়েকদিন।
উদ্ধার তৎপরতা জোরদার, সেনাবাহিনী ও দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী মোতায়েন
দেশটির প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউম (Claudia Sheinbaum) জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর (SEDENA ও Protección Civil) মোতায়েন করা হয়েছে।
তারা উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজে নিয়োজিত আছে।
শেইনবাউম বলেন,
“আমাদের অগ্রাধিকার এখন মানুষের জীবন রক্ষা ও দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। আমরা প্রতিটি প্রদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছি এবং উদ্ধার অভিযান দিনরাত চলবে।”
উদ্ধারকর্মীরা নৌকা ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে দূরবর্তী পাহাড়ি এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের সরিয়ে নিচ্ছেন।
অবিরাম বৃষ্টির কারণে অনেক জায়গায় উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।
ভূমিধস ও সড়ক দুর্ঘটনায় বেড়েছে হতাহতের সংখ্যা
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, শুধু ভেরাক্রুজেই ৩০টিরও বেশি জায়গায় ভূমিধস হয়েছে।
অনেক স্থানে পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি চাপা পড়েছে, সড়ক ধসে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কয়েকটি জেলা।
পুয়েবলা রাজ্যের গভর্নর হুলিও মেন্ডোজা জানিয়েছেন,
“আমরা এখনো কিছু গ্রামে পৌঁছাতে পারিনি। সড়কগুলো ধসে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে আরও কিছু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।”
সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটছে বৃষ্টিজনিত কারণে। পিচ্ছিল রাস্তায় অন্তত দশটির বেশি গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতি, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা
মেক্সিকোর কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই বন্যায় প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
বিশেষ করে ভুট্টা, শিম ও আখের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
এতে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং খাদ্যের দাম বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি খাতের ক্ষতির কারণে স্থানীয় অর্থনীতি অন্তত ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়বে।
শিশু ও প্রবীণদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি
উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন শিশু ও প্রবীণরা।
তারা পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, বিশেষ করে ডায়রিয়া ও ত্বকজনিত সংক্রমণে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রস মেক্সিকো (Red Cross Mexico) জানায়, এখন পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং তারা মানবিক সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের জরুরি ত্রাণ তহবিল ঘোষণা
প্রেসিডেন্ট শেইনবাউম দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য “জাতীয় ত্রাণ তহবিল” (National Relief Fund) থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন।
এই অর্থ ব্যবহার করা হবে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত, আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও ত্রাণ বিতরণে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
আবহাওয়ার উন্নতি হলেও নতুন ঝুঁকি রয়ে গেছে
মেক্সিকোর আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এখন বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কিছুটা কমেছে।
তবে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে এখনো ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া নদীগুলোর পানি এখনো বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় নতুন করে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সমুদ্রের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এমন প্রবল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
জনগণের আহ্বান ও সহমর্মিতা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্যার ভয়াবহতা নিয়ে নানা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশজুড়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সাধারণ মানুষ একত্র হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
অনেকেই খাদ্য, পোশাক ও ওষুধ সংগ্রহ করে দুর্গত এলাকায় পাঠাচ্ছেন।
স্থানীয় নাগরিক লুইস মার্টিনেজ বলেন,
“আমরা জীবনে এমন বন্যা কখনও দেখিনি। এখন একে অপরকে সাহায্য করাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।”
মেক্সিকোতে এবারের বন্যা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি দেশটির অবকাঠামো ও জলবায়ু প্রস্তুতির বাস্তব চিত্র উন্মোচন করেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন বন্যা ও ঝড় এখন নিয়মিত হতে পারে।
তাই ভবিষ্যতের জন্য এখনই প্রয়োজন টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, কার্যকর পূর্বাভাস ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
MAH – 13294 I Signalbd.com