
দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব সামরিক ক্ষমতায় নৌবাহিনী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরীতে মোতায়েন করা স্টিলথ প্রযুক্তির এফ-৩৫সি লাইটনিং II ফাইটার জেট ছিল একমাত্র অস্ত্র, যা নৌযুদ্ধে আধুনিকতা ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু এখন সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে চীন।
চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মি নেভি (PLAN) সম্প্রতি তাদের নৌবাহিনীতে প্রথমবারের মতো স্টিলথ ফাইটার ‘সেনইয়াং জে-৩৫’ কে প্রাথমিক অপারেশনাল পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এটি মার্কিন নৌবাহিনীর আধিপত্যকে সরাসরি টক্কর দিতে সক্ষম হতে চলেছে, যা সামুদ্রিক সামরিক ভারসাম্যের জন্য একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
চীনের নতুন স্টিলথ ফাইটার সেনইয়াং জে-৩৫: একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব
সেনইয়াং জে-৩৫ হলো চীনের প্রথম ক্যারিয়ার-ভিত্তিক স্টিলথ ফাইটার, যা আধুনিক সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যান্ত্রিক উন্নয়ন। এর সাহায্যে চীন তাদের বিমানবাহী রণতরীতে স্টিলথ প্রযুক্তির ক্ষমতা যোগাতে সক্ষম হয়েছে, যা গোপনীয়তা, ত্বরান্বিত গতি, এবং উচ্চমানের যুদ্ধক্ষমতা নিয়ে গঠিত।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে বর্তমানে ১১০টিরও বেশি এফ-৩৫সি স্টিলথ ফাইটার জেট মোতায়েন আছে। এর মাধ্যমে মার্কিন নৌবাহিনী বিশ্বসেরা নৌ যুদ্ধ সামর্থ্য বজায় রেখেছে। কিন্তু চীনের সেনইয়াং জে-৩৫ আসার মাধ্যমে এই আধিপত্যের ভারসাম্য পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
চীনের বিমানবাহী রণতরী: সংখ্যা ও প্রযুক্তির দিক থেকে দ্রুত অগ্রগতি
চীন বর্তমানে নৌবাহিনীতে মাত্র দুইটি বিমানবাহী রণতরী (অ্যাকটিভ সার্ভিসে লিয়াওনিং এবং শানডং) পরিচালনা করছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। তবে চীনের সামরিক নির্মাণশিল্প গত কয়েক বছরে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
চীনের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’ বর্তমানে সমুদ্র পরীক্ষার ধাপে রয়েছে। এর পরেই নির্মাণাধীন চতুর্থ বিমানবাহী রণতরী ‘টাইপ-০০৪’ আসবে, যা পারমাণবিক শক্তিচালিত হবে। এই উন্নয়নের ফলে চীন ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ ও শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলতে পারবে।
মার্কিন আধিপত্য ও চীনের প্রতিযোগিতা: সামুদ্রিক যুদ্ধের নতুন অধ্যায়
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর আধিপত্যের মূল কারণ তাদের পারমাণবিক চালিত বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা এবং স্টিলথ প্রযুক্তিতে প্রাধান্য। তবে চীনের দ্রুত অগ্রগতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের ফাইটার জে-৩৫ ও নবনির্মিত রণতরী সমুদ্রের যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে দীর্ঘমেয়াদে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
কেন চীনের স্টিলথ ফাইটার জে-৩৫ গুরুত্বপূর্ণ?
- স্টিলথ প্রযুক্তি: চীনের জে-৩৫ ফাইটারটি গোপনীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম, যা রাডার ও অন্যান্য অনুসন্ধান ব্যবস্থার চোখ এড়াতে সাহায্য করে।
- ক্যারিয়ার-বেইজড অপারেশন: এটি ক্যারিয়ার থেকে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে, যা নৌবাহিনীর স্ট্রাইক পাওয়ার বাড়ায়।
- উচ্চ গতি ও অগ্রিম অস্ত্র: জে-৩৫ উন্নত মিসাইল ও বোমা বহন করতে সক্ষম, যা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর।
- স্থানীয় উৎপাদন: চীনে সম্পূর্ণরূপে নির্মিত হওয়ায় এটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে।
ভবিষ্যতের প্রভাব: চীনের সামরিক আধিপত্যের প্রসার
চীন তাদের নৌবাহিনীতে স্টিলথ ফাইটার জে-৩৫ যোগ করার মাধ্যমে সমুদ্রের যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। এর মাধ্যমে তারা দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার আরো দ্রুত ও দৃঢ় করতে পারবে।
এছাড়া, নৌবাহিনী আধুনিকায়নের এই ধারা চীনের সামরিক কৌশলকে আরো বহুমাত্রিক ও দূরদর্শী করেছে, যা সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
চীনের সামরিক আধুনিকায়ন: পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ
- চীনের সামরিক বাজেট গত দশকে প্রতি বছর গড়ে ৭-৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।
- বিমানবাহী রণতরীর নির্মাণ গতিবেগ এখন বিশ্বে অন্যতম দ্রুত।
- চীনের ড্রোন, মিসাইল ও সাইবার যুদ্ধ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সামগ্রিক সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
চীনের সামরিক আধুনিকায়নের প্রতি বিশ্ববাসীর মনোযোগ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো এ ব্যাপারে সতর্ক হয়ে নিজেদের সামরিক নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য সামরিক শক্তিগুলোও চীনের এই অগ্রগতি নজরদারি করছে। ফলে আগামী দিনে সমুদ্রযুদ্ধ ও সামরিক প্রতিযোগিতার পরিমণ্ডল পরিবর্তিত হবে।
চীনের সেনইয়াং জে-৩৫ স্টিলথ ফাইটার নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে সমুদ্রের সামরিক ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এসেছে। দীর্ঘদিনের মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন তাদের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী বছরগুলোতে চীনের এই পদক্ষেপ সমুদ্রের গতি ও কৌশল সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিতে পারে।