বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রে গির্জায় ভয়াবহ বন্দুক হামলা ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪ নিহত

Advertisement

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে একটি গির্জায় বন্দুকধারীর সশস্ত্র হামলা ও অগ্নিসংযোগে কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত আরও ৮ জন। ভয়াবহ এই হামলার ঘটনায় পুরো আমেরিকা শোকাহত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

আল জাজিরা ও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিশিগানের গ্র্যান্ড ব্ল্যাঙ্ক টাউনশিপে অবস্থিত “দ্য চার্চ অব জেসাস ক্রাইস্ট অব ল্যাটার-ডে সেন্টস” নামের একটি গির্জায় এ হামলার ঘটনা ঘটে।

কীভাবে ঘটলো এই হামলা?

সাক্ষীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, গির্জায় সাপ্তাহিক প্রার্থনায় কয়েকশ’ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি গাড়ি চালিয়ে গির্জার প্রধান দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর গাড়ি থেকে বের হয়েই তিনি এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লোকজন প্রাণ বাঁচাতে গির্জার ভেতরে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করেন। অনেকেই টেবিল-চেয়ারের আড়ালে আশ্রয় নেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে বহু মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

এরপরও থামেনি হামলাকারী। সে গির্জার একটি অংশে দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের ভেতরে। এর ফলে ভবনের একটি অংশ ভেঙে পড়ে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে যায় কয়েকজন।

হামলাকারীর পরিচয়

পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীর নাম থমাস জ্যাকব স্যানফোর্ড (বয়স ৪০ বছর)। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা হলেও সম্প্রতি মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারীর অতীতে চার্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ থাকতে পারে।

পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি

খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় নিরাপত্তা বাহিনী। তখনও বন্দুকধারী গুলি চালাচ্ছিল। প্রায় ২০ মিনিট ধরে পুলিশের সঙ্গে তার বন্দুকযুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত সে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।

হতাহতের সংখ্যা

পুলিশের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন,

  • ঘটনাস্থলেই ২ জন নিহত হন।
  • পরবর্তীতে আগুন নেভানোর পর গির্জার ভেতর থেকে আরও ২টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
  • এখন পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ জনে।
  • এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অন্তত ৮ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

গির্জায় অগ্নিকাণ্ড

ফায়ার সার্ভিস জানায়, গির্জার ভেতরে হামলাকারীর লাগানো আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তবে ভবনের একটি বড় অংশ ধসে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপে আরও হতাহত থাকতে পারে। উদ্ধারকাজ এখনও চলছে।

স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

মিশিগানের গভর্নর এক জরুরি বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন,

“এটি একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আমাদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নষ্ট করার যে চেষ্টা হয়েছে, তা আমরা কখনোই সহ্য করব না।”

তিনি নিহতদের পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দেন এবং পুরো রাজ্যে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেন।

হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন,

“ধর্মীয় উপাসনালয়ে এভাবে নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা বন্দুক সহিংসতা রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেব।”

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার ইতিহাস

আমেরিকায় বন্দুক সহিংসতা নতুন নয়। বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল ও গণসমাবেশে প্রায়ই এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে থাকে।

  • ২০১৭ সালে টেক্সাসের একটি চার্চে বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২৬ জন।
  • ২০১৫ সালে সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটনে এক গির্জায় গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ৯ জনকে।
  • ২০১৮ সালে পিটসবার্গের একটি সিনাগগে (ইহুদি উপাসনালয়) গুলিতে নিহত হয় ১১ জন।

এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমেরিকায় বন্দুক আইনের সংস্কার নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

বন্দুক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক

যুক্তরাষ্ট্রে Second Amendment বা সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী নাগরিকদের অস্ত্র রাখার অধিকার রয়েছে। এই সাংবিধানিক সুরক্ষার কারণেই বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ কারণে প্রতি বছর হাজারো মানুষ বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ (Gun Violence Archive) এর তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৮,০০০ মানুষ।

ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার প্রভাব

ধর্মীয় স্থান সাধারণত শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রার্থনার জায়গা। কিন্তু এ ধরনের হামলা সেখানে উপস্থিত মানুষের মনে গভীর ভয়ের সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব ঘটনার ফলে মানুষ তাদের ধর্মীয় উপাসনা থেকে দূরে সরে যেতে পারে, যা সামাজিক ও মানসিকভাবে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া

গির্জার পাশের বাসিন্দা মার্থা জনসন বলেন,

“আমি গুলির শব্দ শুনে ভেবেছিলাম আতশবাজি ফাটানো হচ্ছে। জানালায় গিয়ে দেখি মানুষ চিৎকার করে দৌঁড়াচ্ছে। আমি তখনই বুঝে যাই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে।”

অন্যদিকে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী না হওয়ায় এ ধরনের হামলা বারবার ঘটছে।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার সমস্যা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

মিশিগানের গ্র্যান্ড ব্ল্যাঙ্ক টাউনশিপে ঘটে যাওয়া এই গির্জায় হামলা আমেরিকার দীর্ঘদিনের বন্দুক সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে।

MAH – 13059 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button