
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজ্জা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির পর গাজ্জা সিটি থেকে আজ শুক্রবারই অন্তত ৩৩টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্র ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এই মরদেহগুলো ইসরাইলি সেনাদের সরে যাওয়ার পর পাওয়া গেছে। মরদেহগুলোর মধ্যে অনেকের শরীর বিকৃত হয়ে গেছে, তাই তাদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য আল-শিফা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আল-শিফা হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা
গাজ্জা উপত্যকায় যত হাসপাতাল আছে, তার মধ্যে আল-শিফা হাসপাতাল একমাত্র এমন প্রতিষ্ঠান যেখানে ফরেনসিক মেডিসিনের বিভাগ রয়েছে। এখানে মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক, ডাক্তার মুহাম্মাদ আবু সালমিয়া সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন, “আজ গাজ্জা সিটি থেকে ৩৩টি মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। তবে আরও মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দিন যত এগোয়, তত নতুন মরদেহ উদ্ধার হতে পারে।”
ফিলিস্তিনের বিভিন্ন হাসপাতাল ও মানবাধিকার সংগঠনও এই মৃত্যুর বিষয়টি নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ গাজ্জায় মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমাগত হুমকির মুখে।
যুদ্ধবিরতি ও সশস্ত্র সংঘাতের প্রেক্ষাপট
গাজ্জা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি সেনাদের অবরোধ এবং সংঘাতের শিকার। সম্প্রতি চলা তীব্র সংঘাত শেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরই স্থানীয়দের দাবি, সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইলি সেনাদের কার্যক্রমের কারণে গাজ্জা শহরে প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছে এবং তাদের অনেকের অবস্থা এখনও অনিশ্চিত।
গাজার স্বাস্থ্য অবস্থা ও মানবিক সংকট
গাজ্জা উপত্যকা বর্তমানে কঠিন মানবিক সংকটে রয়েছে। কয়েক দশক ধরে চলমান অবরোধের ফলে খাবার, পানি, বিদ্যুৎ এবং চিকিৎসা সরবরাহ অত্যন্ত সীমিত। গাজ্জা শহরের হাসপাতালগুলোও আংশিকভাবে কার্যকর। আল-শিফা হাসপাতাল ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে মরদেহ শনাক্তের সুবিধা নেই।
ডাক্তার মুহাম্মাদ আবু সালমিয়া জানান, “আমরা মরদেহ শনাক্ত এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। তবে আমাদের সীমিত সরঞ্জাম এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে কাজটা খুবই কঠিন।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছে, দ্রুত সাহায্য না পৌঁছালে গাজার জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সংযুক্ত জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইতিমধ্যেই ইসরাইলকে সতর্ক করেছে। তাদের বক্তব্য, গাজ্জার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সামরিক অভিযান চালানো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনগুলোও সম্প্রতি গাজার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিক্ষোভ ও শান্তি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন ইসরাইলি সেনাদের কর্মকাণ্ড থামাতে এবং গাজার মানুষদের প্রতি মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করে।
গাজার সাধারণ মানুষের চরম বিপর্যয়
স্থানীয়রা জানান, যুদ্ধবিরতির পরও শহরের রাস্তাঘাটে ভয়াবহ ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, শিশু ও বৃদ্ধরা আতঙ্কে ভুগছে। অপ্রতুল খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা পরিষেবা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ফিলিস্তিনের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা শুধু বেঁচে থাকতে চাই। যুদ্ধবিরতি হলেও আমাদের ঘর-বাড়ি নেই, আমরা নিরাপদ স্থান খুঁজছি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার মানুষদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে থাকবে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ মনোযোগ দরকার।
ফরেনসিক মেডিসিন এবং মরদেহ শনাক্তকরণের গুরুত্ব
আল-শিফা হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ মরদেহ শনাক্তকরণে বিশেষজ্ঞ। তারা দেহের জেনেটিক টেস্ট, আঙ্গুলের ছাপ এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিচয় নির্ধারণ করছে। এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করতে পারবে এবং যথাযথ সমাধি দিতে পারবে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, মরদেহগুলো বিকৃত হওয়ায় প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় নিতে পারে। তবে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে যত দ্রুত সম্ভব পরিচয় নির্ধারণ করা হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
গাজার স্থানীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মিলিতভাবে কাজ করছে। তারা মরদেহ শনাক্তকরণ, আহতদের চিকিৎসা এবং মানবিক সাহায্য দ্রুত পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতিমধ্যেই গাজার হাসপাতালগুলোর জন্য জরুরি মেডিকেল কিট পাঠানোর ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা শক্তিশালী হবে এবং রোগীদের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে।
গাজার জনগণের আহ্বান
গাজার সাধারণ মানুষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানাচ্ছে। তারা চাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের সংঘাতের পুনরাবৃত্তি না হয় এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা বজায় থাকে।
স্থানীয় সংগঠনগুলো বলছে, “যুদ্ধবিরতির পরও আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। মানুষ মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না, তারা বেঁচে থাকতে চায়।”
গাজার পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। ইসরাইলি সেনাদের সরে যাওয়ার পর মৃতদেহ উদ্ধার এবং পরিচয় শনাক্তকরণ শুরু হলেও, মানবিক সংকট এবং নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা, মেডিকেল সাহায্য এবং মানবাধিকার রক্ষা করা জরুরি।
ফিলিস্তিনের জনগণ আশা করছে, আন্তর্জাতিক মহল তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং গাজার মানুষদের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করবে।
MAH – 13270 I Signalbd.com