বিশ্ব

কাবুলে বিস্ফোরণের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করল তালেবান সরকার

Advertisement

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ও পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা প্রদেশে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের জন্য পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেছে তালেবান সরকার। এ ঘটনার পর প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বিস্ফোরণের খবর নিশ্চিত করলেও শুরুতে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেননি। তবে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে দায়ী করার পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় ওঠে।

পাকিস্তানকে সরাসরি অভিযুক্ত করল তালেবান

শুক্রবার আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, কাবুল ও পাকতিকায় সংঘটিত বিস্ফোরণ পাকিস্তানের পরিকল্পিত হামলার ফলাফল। যদিও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি অস্বীকার করেনি, তবে প্রকাশ্যে দায়ও নেয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, “আফগানিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, যা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী।”

জাবিহুল্লাহ মুজাহিদের প্রথম প্রতিক্রিয়া

বৃহস্পতিবার বিস্ফোরণের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ (সাবেক টুইটার) জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ পশতু ভাষায় লেখেন, “কাবুলে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। তদন্ত চলছে।” তবে তিনি শুরুতে হামলার জন্য কাউকে দায়ী করেননি।

টিটিপিকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক

কাবুলের রাজনৈতিক মহল ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বিস্ফোরণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের কট্টরপন্থী সংগঠন তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–এর শীর্ষ নেতৃত্ব। সম্প্রতি টিটিপির প্রধান নুর ওয়ালি মেহসুদের কাবুলে অবস্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের দাবি, পাকিস্তান বিমান হামলার মাধ্যমে সরাসরি তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তবে পরে আফগান কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, মেহসুদ নিরাপদে আছেন।

পাকিস্তানের দ্বিধান্বিত প্রতিক্রিয়া

ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আহমদ শরিফকে প্রশ্ন করা হয়, আফগানিস্তানের ভেতরে টিটিপি নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে বিমান হামলা চালানো হয়েছিল কি না। তিনি জবাবে স্পষ্টভাবে অস্বীকারও করেননি, আবার নিশ্চিতও করেননি।

শরিফ বলেন, “আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আমাদের হাতে এর প্রমাণ আছে। পাকিস্তানের জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

ভারত সফরে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সময়টি তাৎপর্যপূর্ণ

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফরের প্রথম দিনেই এই বিস্ফোরণ ঘটে। এটি তালেবান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো মন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর। ছয় দিনের এই সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত–তালেবান সম্পর্কের উষ্ণতা পাকিস্তানের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে।

আফগানিস্তান–পাকিস্তান সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই জটিল। ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর ইসলামাবাদ ভেবেছিল, নতুন সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।

পাকিস্তান বহুবার অভিযোগ করেছে যে, তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় ও সহায়তা দিচ্ছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর টিটিপির হামলা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আফগানিস্তানের ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি করে আসছে ইসলামাবাদ। অন্যদিকে তালেবান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

টিটিপি কী এবং কেন পাকিস্তানের জন্য হুমকি?

তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটি আফগান তালেবানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেও সরাসরি তাদের অধীনে নয়।

টিটিপি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারি স্থাপনা এবং বেসামরিক মানুষদের ওপর একাধিক ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। ২০১৪ সালে পেশোয়ার আর্মি পাবলিক স্কুলে হামলায় ১৩০–এর বেশি শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হয়েছিল।

পাকিস্তানের ধারণা, আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় টিটিপি নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। তালেবান সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে টিটিপিকে সহায়তা করছে।

ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ

আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানের জন্য বড় ধাক্কা। কয়েক দশক ধরে ভারত আফগানিস্তানে উন্নয়ন প্রকল্প ও সহায়তার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর ভারত কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলেও বর্তমানে আবারও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।

পাকিস্তান আশঙ্কা করছে, ভারত–তালেবান ঘনিষ্ঠতা তাদের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক অবস্থানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক কার্যক্রম যদি অব্যাহত থাকে, তবে এটি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে।

জাতিসংঘও ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হলে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হবে।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তা হচ্ছে উল্টো। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ, সন্ত্রাসবাদ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে প্রতিদিন আরও জটিল করে তুলছে।

যদি পাকিস্তান ভবিষ্যতেও আফগানিস্তানের ভেতরে সামরিক হামলা চালাতে থাকে, তবে সরাসরি দুই দেশের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে শুধু আফগানিস্তান–পাকিস্তান নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনীতিই নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।

MAH – 13261 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button