
অস্ট্রেলিয়ায় এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় অন্তত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকালে নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যের শেলহারবার বিমানবন্দরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দেশটির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, একটি হালকা বেসামরিক বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়।
দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিচয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, বিমানটিতে থাকা সবাই প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন পাইলট এবং বাকি দুইজন যাত্রী।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, স্থানীয় সময় সকাল ১০টার দিকে সিডনি থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শেলহারবার বিমানবন্দর থেকে ছোট বিমানটি আকাশে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং মাটিতে আছড়ে পড়ে। ভূমিতে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়।
ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ নিউ সাউথ ওয়েলসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু এর আগেই বিমানের ভেতরে থাকা তিনজন প্রাণ হারান।
দুর্ঘটনার পর তদন্ত শুরু
অস্ট্রেলিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (Civil Aviation Safety Authority – CASA) ইতিমধ্যেই দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শুরু করেছে। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ট্রান্সপোর্ট সেফটি ব্যুরো (ATSB) একটি বিশেষ দল পাঠিয়েছে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, যান্ত্রিক ত্রুটি অথবা উড্ডয়নের সময় কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা থেকে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
স্থানীয় কিছু প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আকাশে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি অস্বাভাবিকভাবে দুলতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই তীব্র শব্দ করে সেটি নিচে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।
শেলহারবার বিমানবন্দরের আশেপাশে বসবাসকারী অনেকে দুর্ঘটনার সময় আতঙ্কে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের একজন বলেন, “বিমানটি আকাশে হঠাৎ কাঁপতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।”
নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ এ দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “প্রাণ হারানোদের পরিবার ও প্রিয়জনদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা রইল। অস্ট্রেলিয়ার বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা, তবুও এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের সবাইকে ব্যথিত করে।”
নিউ সাউথ ওয়েলসের মুখ্যমন্ত্রীও নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং তদন্ত দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস
অস্ট্রেলিয়া বিমান নিরাপত্তার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত হলেও অতীতে দেশটিতে একাধিক ছোট বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে।
- ২০২৩ সালে ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে একটি হালকা বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুই জন নিহত হয়েছিলেন।
- ২০১৭ সালে মেলবোর্নে একটি চার্টার বিমান শপিং সেন্টারের ওপর আছড়ে পড়ে, যাতে পাঁচজন প্রাণ হারান।
- ২০০৫ সালে লকহার্ট নদীতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় ১৫ জন যাত্রী মারা যান।
এই দুর্ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, বাণিজ্যিক বড় বিমানগুলো সাধারণত নিরাপদ হলেও ছোট বেসরকারি বিমান প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
বিমান নিরাপত্তা ও ঝুঁকি
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর শতাধিক ছোট বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়—
- যান্ত্রিক ত্রুটি: ছোট বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া বড় এয়ারলাইনের তুলনায় সীমিত।
- আবহাওয়া সমস্যা: হঠাৎ ঝড়ো বাতাস বা খারাপ আবহাওয়ায় হালকা বিমান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- পাইলটের অভিজ্ঞতা: অনেক ক্ষেত্রে কম অভিজ্ঞ পাইলট ছোট বিমান পরিচালনা করেন।
- প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: ছোট বিমানে উন্নত নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে ছোট বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
শেলহারবার বিমানবন্দর সম্পর্কে
শেলহারবার বিমানবন্দর সিডনি শহরের কাছেই অবস্থিত একটি আঞ্চলিক বিমানবন্দর। মূলত প্রশিক্ষণ, ব্যক্তিগত ভ্রমণ এবং ছোট চার্টার ফ্লাইটের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এলাকাটি পর্যটনের জন্যও জনপ্রিয়, কারণ এখানে সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নৌবিহারের সুযোগ রয়েছে।
দুর্ঘটনার পর সাময়িকভাবে বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে বিমান দুর্ঘটনা ঘটলেও সেটি সাধারণত ছোট ও বেসরকারি বিমানের ক্ষেত্রেই ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।
অস্ট্রেলিয়ার শেলহারবার বিমানবন্দরে তিন প্রাণহানির এই দুর্ঘটনা পুরো দেশকে শোকাহত করেছে। এখনও পর্যন্ত দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা না গেলেও তদন্ত চলছে। বিমান নিরাপত্তার উন্নতি এবং ছোট বিমানের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা না হলে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা আবার ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এখন সবার নজর তদন্ত সংস্থার দিকে। তারা কীভাবে এই দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে এবং ভবিষ্যতে এরকম দুর্ঘটনা এড়াতে কী ব্যবস্থা নেয়—সেটিই দেখার বিষয়।
MAH – 13257 I Signalbd.com