
আজ ৭ অক্টোবর ২০২৫, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুয়ের দুই বছর পূর্ণ হলো। গত ২৪ মাসে গাজাবাসীদের উপর যে ধ্বংসকাণ্ড ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা শুধু সংখ্যার খেলাই নয়, অসংখ্য জীবনের প্রতীক্ষা ও জীবিকার অধঃপতন। এই প্রতিবেদন গাজায় ঘটা ঘটনাবলির পরিসংখ্যান, প্রভাব ও ভবিষ্যতের দিকে চোখ রাখে।
ঘটনা ও তৎকালীন শুরু
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ভোরে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস ও তার সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেড দক্ষিণ ইসরায়েলে এক চমকপ্রদ হামলা চালায়। এক হাজারের অধিক ইসরায়েলি নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি অপহৃত হন। উত্তরে ইসরায়েল মুহূর্তে গাজার ওপর বিমান ও স্থল হামলা চালায় এবং পুরো অঞ্চলকে অবরুদ্ধ করে দেয়।
এই অভিযান সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সঙ্কটপূর্ণ বোমাবর্ষণ ও অবিরাম গুলিবর্ষণ। গাজার বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাসিন্দারা কার্যত মানববন্ধনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পটভূমি ও পূর্বসূরী সংঘাত
গাজাই বহু বছর ধরে অবরুদ্ধ এবং যুদ্ধের ছায়ায় ছিল। যদিও পৃথকভাবে সংঘাত ঘটেছে, তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে যে আক্রমণ শুরু হলো, সেটি ছিলের মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন রাজনৈতিক ধাক্কা। এই ধাক্কা গাজার জনগণ ও অঞ্চলের অনেকে দীর্ঘকাল থেকে বয়ে আসা অবস্থা ও তত্ত্বগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে — অবরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক নিরসনহীনতা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা লাগাতার সতর্ক করলেও, নির্ধারিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বব্যবস্থা। এ কারণে সেই পটভূমিই দুই বছরের মৃত্যুমিছিল ও ধ্বংসের মঞ্চ হয়ে উঠেছে।
পরিসংখ্যান ও মানবিক বিপর্যয়
- গাজায় গত দুই বছরে কমপক্ষে ৬৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
- নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার শিশু রয়েছে।
- প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার মানুষ আহত হয়েছে, অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু।
- গাজার ১২৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এর মধ্যে ৩৪টি হাসপাতাল সম্পূর্ণ ধ্বংস।
- প্রায় ৮৯ শতাংশ পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, এবং ৯৬ শতাংশ পরিবার এখন পানি নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
- ২০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন।
- শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত — ৯২ শতাংশ স্কুল ভবন পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন।
- বর্তমানে প্রায় ১০,৮০০ জন বন্দি রয়েছেন, যার মধ্যে ৪৫০ শিশু ও ৮৭ নারী।
- সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন, অনেকেই বিচারবহির্ভূত।
এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র নথিভুক্ত তথ্য — প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
গাজার নির্যাতন কেবল প্রাণহানি নয়, এক প্রজন্মের অধিকার ও ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। হাজার হাজার পরিবার খাদ্য ও পানির অভাবে বিপর্যস্ত। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, রোগ বিস্তার, মানসিক সঙ্কট এখন নতুন বাস্তবতা।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, বিভিন্ন দেশ ও নাগরিক সমাজ গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষ করে, হাসপাতাল, স্কুল ও স্থানীয় অবকাঠামোর ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবিক ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টান্তমূলক দায়বদ্ধতা দাবি করেছে।
তবে আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ সীমিতই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শহরশক্তি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে, বা রাজনীতিগত কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গাজায় শান্তি সম্মেলন বা যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ মাঝে মাঝে হয়েছে, তবে স্থায়ী শান্তির চুক্তি এখনো আসেনি।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
গাজায় দুই বছরের এই যুদ্ধে দেখা যায় যে, সংখ্যার আড়ালে অনেক গভীর বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে একেকটি পরিবার, একেকটি মামলা, একেকটি ক্ষত আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ না রেখে অগ্রগতি না হয়, তবে গাজা আরও বড় মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। পাশাপাশি, শান্তিকামী দেশগুলোর উদ্যোগ, মধ্যস্থতা ও ত্রাণপ্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ গাজার মানুষের জন্য আজই জরুরি।
বর্তমানে বিশ্বমানে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠাগুলি আরও সুদৃঢ়ভাবে ভূমিকা নিতে পারে। যুদ্ধাপরাধের তদন্ত, ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে।
গাজায় গণহত্যার দুই বছরে আমরা দেখেছি সংখ্যা গড়া সত্যভ্রষ্টিকেই — প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি শেকড়ের ধ্বংস, প্রতিটি শিশুর কণ্ঠনিহততা একটি সময়ের ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের এই মুহূর্তে গাজা শুধু ধ্বংস নয়, মানবতার এক চরম পরীক্ষা।
আগামী দিনে গাজার মানুষের জন্য শান্তি, পুনর্বাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগ নিতে হবে সকলকে — স্থানীয় ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে। তাহলে ঘূর্ণিঝড়ের পর অভিক্ষিপ্ত ধ্বংসস্তূপ থেকেই শিক্ষিত মানুষরা নতুন আলো করে আনতে পারবে।
এম আর এম – ১৬৬১,Signalbd.com