
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সোমবার ঘটে গেল এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাইকে লক্ষ্য করে এক প্রবীণ আইনজীবী জুতা নিক্ষেপ করেন। আদালতের মতো শৃঙ্খলাপূর্ণ স্থানে এমন ঘটনার ফলে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যান। তবে প্রধান বিচারপতি শান্ত ও সংযত থেকে শুনানি চালিয়ে যান, যা আদালতের মর্যাদা রক্ষায় নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বিস্তারিত
সোমবার সকালে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে দিনের প্রথম মামলার শুনানি শুরু হয়। সেই সময় হঠাৎ আদালতকক্ষের একপাশ থেকে ৭১ বছর বয়সী আইনজীবী কিশোর রাকেশ চিৎকার করে বলেন, “সনাতন ধর্মের অপমান ভারত সহ্য করবে না।” এরপর তিনি প্রধান বিচারপতির দিকে একটি জুতা নিক্ষেপ করেন। সৌভাগ্যবশত জুতাটি বেঞ্চে পৌঁছায়নি এবং বিচারপতিকে আঘাত করেনি।
ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মীরা দ্রুত পদক্ষেপ নেন এবং অভিযুক্তকে আদালতকক্ষ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। পরে তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া হয় এবং ঘটনার তদন্ত শুরু করে দিল্লির নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
অভিযুক্ত আইনজীবীর পরিচয় ও প্রবেশপথ
তদন্তে জানা গেছে, কিশোর রাকেশ নামের ওই ব্যক্তি আদালতের আইনজীবী বা ক্লার্কদের জন্য প্রদত্ত একটি “প্রক্সিমিটি কার্ড” ব্যবহার করে আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। সাধারণত এই কার্ডগুলো কেবল অনুমোদিত পেশাজীবীদের দেওয়া হয়, যা তাকে আদালতের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়। তার এই কার্ডটি কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কীভাবে ফাঁকফোকর তৈরি হলো, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির কিছু মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারেন। তবে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনও পরিষ্কার নয়।
সম্ভাব্য কারণ
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিচারপতি গাভাই সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের মুখে ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দিরে বিষ্ণু দেবতার একটি মূর্তি পুনর্নির্মাণ সংক্রান্ত এক জনস্বার্থ মামলায় তিনি শুনানি নিতে অস্বীকার করেন। সেই সময় আদালতে তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন, “যাও, দেবতাকে নিজে কিছু করে দেখাতে বলো।” এই মন্তব্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকে সামাজিক মাধ্যমে বিচারপতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করেন।
অনুমান করা হচ্ছে, এই ঘটনাই হয়তো অভিযুক্তের উত্তেজনার কারণ। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা সংস্থা কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিচ্ছে না।
আদালতের প্রতিক্রিয়া ও প্রধান বিচারপতির সংযম
ঘটনার সময় উপস্থিত আইনজীবীরা জানান, জুতা নিক্ষেপের মুহূর্তেও প্রধান বিচারপতি গাভাই শান্তভাবে বসে ছিলেন। তিনি সংযম বজায় রেখে বলেন, “আমি এমন ঘটনায় সবচেয়ে কম প্রভাবিত ব্যক্তি।” এরপর কোনো বিঘ্ন ছাড়াই তিনি শুনানি চালিয়ে যান।
এই ঘটনায় আদালতের ভেতরে থাকা সবাই প্রধান বিচারপতির এই ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশংসা করেছেন।
সিনিয়র আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং এক পোস্টে লিখেছেন,
“প্রধান বিচারপতি গাভাই আদালতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ধরনের আক্রমণ বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার ওপর স্পষ্ট হুমকি, যা সকল বিচারপতির একত্রে নিন্দা জানানো উচিত।”
বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের মতামত
ভারতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিশ্লেষকদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের মতো জায়গায় এমন ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নজিরবিহীন। দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই ঘটনা আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে এমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে অবিলম্বে নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি।”
অন্যদিকে, আইনি মহলে আলোচনা হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে। কেউ কেউ মনে করছেন, এ ঘটনা আদালতের স্বাধীন বিচারিক ক্ষমতাকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হতে পারে।
আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রশ্ন
ভারতের সর্বোচ্চ আদালতকে নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থাপনাগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। তবু এমন একটি ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে—কীভাবে একজন সাধারণ আইনজীবী প্রক্সি কার্ড ব্যবহার করে এত সহজে আদালতের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেন?
দিল্লি পুলিশ ইতোমধ্যে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি রেকর্ড বিশ্লেষণ শুরু করেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নিরাপত্তা প্রটোকলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হতে পারে।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও সম্ভাব্য প্রভাব
ভারতের বিচারবিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। আদালতের প্রশাসন ভবিষ্যতে প্রবেশপত্র ব্যবহারের প্রক্রিয়া আরও কঠোর করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এমন ঘটনা শুধু আদালতের মর্যাদা নয়, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি মানুষের আস্থাকেও নাড়া দিতে পারে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। যদিও বিচারপতি গাভাই শান্তভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, তবু এই ঘটনা বিচারব্যবস্থার নিরাপত্তা ও সম্মান নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এনে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই ঘটনার পর আদালত ও সরকার কত দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা আবারও প্রতিরোধ করা যায় কি না।
এম আর এম – ১৬৪১,Signalbd.com