
চীনে বহুল আলোচিত মিং মাফিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অবশেষে কঠোর রায় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতারণা, মাদক ও অবৈধ জুয়া ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এই পরিবারের ১১ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। সোমবার স্থানীয় সময় পূর্বাঞ্চলীয় ওয়েনঝো শহরে চাঞ্চল্যকর এই রায় ঘোষণা করা হয়।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, মোট ৩৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শেষ হয়। তাদের মধ্যে ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড, পাঁচজনকে স্থগিত মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের পাঁচ থেকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মিং পরিবারের অপরাধ সাম্রাজ্য
মিয়ানমার-চীন সীমান্ত ঘেঁষা লাওকাই শহর দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ কার্যক্রমের জন্য কুখ্যাত। স্থানীয় সূত্র বলছে, চারটি প্রভাবশালী মাফিয়া পরিবার মিলে পুরো অঞ্চলটিকে জুয়া, মাদক ও প্রতারণার ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে পরিচিত ছিল মিং পরিবার।
২০১৫ সাল থেকে তারা অবৈধ ক্যাসিনো, টেলিযোগাযোগ প্রতারণা, মাদক পাচার এবং যৌনকর্মী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছিল। শুধু প্রতারণা ও জুয়ার মাধ্যমেই তারা প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আয় করেছে বলে আদালতে উল্লেখ করা হয়।
সীমান্তে অপরাধের বিস্তার
চীনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, মিয়ানমার-চীন সীমান্ত অঞ্চল বহু বছর ধরেই আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক পাচারের মতো গুরুতর অপরাধও এখানেই পরিচালিত হতো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই অঞ্চলের দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং সীমান্তবর্তী এলাকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অপরাধচক্রগুলোর শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছিল।
মিয়ানমারের অভিযানের পর চীনের পদক্ষেপ
২০২৩ সালে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ব্যাপক অভিযান শুরু করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। শত শত অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয় এবং অনেককে চীনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই সময় থেকেই মিং পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত জোরদার করা হয়।
চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ তদন্ত শেষে ওয়েনঝো আদালত ৩৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যেই আসে ইতিহাসের অন্যতম কঠোর রায়—১১ জনের মৃত্যুদণ্ড।
জনমনে প্রতিক্রিয়া
চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। অনেকেই মনে করছেন, এত বড় একটি অপরাধচক্রকে ভেঙে ফেলা দেশটির আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার জন্য এক বিশাল সাফল্য।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, অপরাধীরা দোষী হলেও মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে কঠোর কারাদণ্ডই যথেষ্ট ছিল।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক নজর
চীনের অভ্যন্তরে টেলিযোগাযোগ প্রতারণা এবং অনলাইন জুয়া ব্যবসা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায়ও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায়ের মাধ্যমে চীন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কঠোর বার্তা দিল যে তারা সীমান্তবর্তী অপরাধচক্র দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকেও এ ধরনের অপরাধ দমনে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
মিং পরিবারের পতনের মধ্য দিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের অপরাধচক্রে বড় ধাক্কা লাগলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। চারটি প্রভাবশালী মাফিয়া পরিবারের মধ্যে তিনটির এখনও কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ধরনের অপরাধ দমনে শুধু কঠোর রায় নয়, দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি ও আঞ্চলিক সহযোগিতাও জরুরি।
চীনে মিং পরিবারের ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড দেশটিতে অপরাধ দমনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে অপরাধচক্রের মূল শেকড় উপড়ে না ফেললে একই ধরনের সমস্যা ভবিষ্যতেও ফিরে আসতে পারে। এখন নজর থাকবে—চীন ও মিয়ানমার যৌথভাবে কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।
এম আর এম – ১৫৬৪,Signalbd.com