বিশ্ব

ফ্রান্সসহ ৬ দেশের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি

Advertisement

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার খবর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সাড়া ফেলেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ ফ্রান্সসহ আরও ছয় দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ঘটনা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের পটভূমিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের অবস্থানের শক্তিশালী স্বীকৃতি মিলেছে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) বার্ষিক অধিবেশনের আগে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ফ্রান্স, অ্যান্ডোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা এবং মোনাকো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। বৈঠকটি সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করা হয়েছিল। এ সময় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্যের নেতারাও বক্তব্য রাখেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য এ ঘোষণার ঠিক আগের দিনই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরন বৈঠকে বলেন

“আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি কারণ সময় এসেছে। আমাদের দায়িত্ব হলো দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।”

তারপর তিনি ঘোষণা দেন,

“আজ আমি ঘোষণা করছি, ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।”

এই স্বীকৃতির ফলে এখন বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ১৪৭টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক চাপ আরও বেড়েছে।

ফিলিস্তিন-গাজার পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানে গাজার সাধারণ মানুষ বিপুল মানবিক সঙ্কটে রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ৬৫ হাজার ৩০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং পুরো গাজা নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

গত বছর স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশেষত, গাজার যুদ্ধের পর স্পেন ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে।

সোমবারের বৈঠকে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন,

“যখন কোনো এক রাষ্ট্রের জনগণ গণহত্যার শিকার হয়, তখন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কার্যকরভাবে সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনি জনগণ ধ্বংসের মুখে। তাই আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের এই হত্যাযজ্ঞ থামাতে হবে।”

বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট ম্যাকরন গাজার জন্য যুদ্ধোত্তর একটি নতুন কাঠামোর রূপরেখা দেন। এতে একটি ‘নতুন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। এছাড়াও তিনি একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (ISF) মোতায়েনের কথাও বলেন, যা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজায় শাসনভার গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করবে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পাওয়ায় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সরাসরি অধিবেশনে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি ভিডিওবার্তায় বক্তব্য দেন এবং ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর প্রতি ধন্যবাদ জানান। এছাড়া তিনি এমন দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান যারা এখনও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। মাহমুদ আব্বাস একই সঙ্গে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিশ্চিত করার দাবি জানান।

ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকটি বর্জন করে। ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি ড্যানন বৈঠকটিকে ‘সার্কাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যদিও জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতির গুরুত্ব

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। এটি কেবল একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং মানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। স্বীকৃতি প্রাপ্ত দেশগুলো ফিলিস্তিনকে বৈধ রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেনে নেয়, যা ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। এটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

গাজার মানবিক সংকট

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সংখ্যালঘু না হলেও, সামরিক অভিযানে শহরাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, বাজার এবং আবাসিক এলাকা ধ্বংসপ্রায়, যা হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সংকট মোকাবিলায় জরুরি সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি এবং চাপ না থাকলে গাজার পুনর্গঠন এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কার্যকরভাবে সম্ভব হবে না। ফ্রান্সসহ ছয় দেশের এই পদক্ষেপ গাজার মানবিক সহায়তা এবং স্থায়ী শান্তির পথে একটি বড় ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ফ্রান্সসহ ছয় দেশের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী করবে। এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিলিস্তিনের অবস্থান সুদৃঢ় করবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নতুন দিশা দেখাবে। তবে পূর্ণ সদস্যপদ এবং নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এক নতুন দায়িত্বও তৈরি করেছে। এতে শুধু ফিলিস্তিনের স্বার্থই রক্ষা হবে না, বরং ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথও খুলে যাবে।

ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকো এই উদ্যোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি একদিকে মানবিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়। এটি কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং মানবিক ন্যায় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। ফ্রান্সসহ ছয় দেশের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে—ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া সময়ের দাবি এবং মানবিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।

গাজা পুনর্গঠন, শান্তি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আগামী সময়ে আন্তর্জাতিক চাপ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের স্থায়ী সমাধান আসা সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে।

MAH – 12965 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button