
গাজায় চলমান সংঘাতের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ইসরায়েলের কাছে নতুন এক বিশাল অস্ত্র চালানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নতুন চুক্তির মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ৬৪০ কোটি ডলার, যা সামরিক সরঞ্জাম, হেলিকপ্টার, ট্যাংক এবং গোলাবারুদ নিয়ে গঠিত।
এই সিদ্ধান্তটি আসে এমন সময় যখন বিশ্বজুড়ে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য শান্তি আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। তবুও ট্রাম্প প্রশাসন এ ধরনের অস্ত্র চালান অনুমোদন দিয়ে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর পথে এগোচ্ছে।
নতুন অস্ত্র চালান: বিস্তারিত
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে ট্রাম্প প্রশাসন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের কর্মকর্তা-সমূহের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে, এই নতুন অস্ত্র চালানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
- ৩০টি এএইচ-৬৪ অ্যাপাচে অ্যাটাক হেলিকপ্টার
- ৩,২৫০টি ইনফ্যান্ট্রি অ্যাসল্ট ভেহিকেল বা ট্যাংক
- হেলিকপ্টার ও ট্যাংকের আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ ও গোলাবারুদ
মূল্য হিসেবে হেলিকপ্টারগুলোর দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৩৮০ কোটি ডলার, আর ট্যাংকের দাম ১৯০ কোটি ডলার। বাকি ৭০ কোটি ডলার হেলিকপ্টার ও ট্যাংকের যন্ত্রাংশ এবং গোলাবারুদ বাবদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অস্ত্রগুলো ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং গাজার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও ঘনিষ্ঠ করবে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান
প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল সম্প্রতি গাজা দখলের উদ্দেশ্যে একটি ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করেছে।
এই অভিযান ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর হামলায় ইসরায়েলের ১,২০০ নাগরিক নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে রাখা হয়। এরপর ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময় গাজায় নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৬২ হাজারের বেশি, আর আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার মানুষ। এ পরিস্থিতিতে নতুন অস্ত্র চালান সংঘাতের তীব্রতা বাড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং মানবিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত দুই বছরে ৬ বার গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করে প্রস্তাবগুলো নাকচ করেছে।
ফ্রান্স এবং সৌদি আরব আগামী ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। এই সম্মেলনের প্রস্তুতির মধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে।
মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ক ও কৌশল
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বহু বছর ধরে দৃঢ়।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক সাহায্যকারী দেশের মধ্যে অন্যতম।
- প্রতিবছর ইসরায়েলের জন্য মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য অনুমোদন করা হয়।
- ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন সিদ্ধান্ত পূর্ববর্তী প্রশাসনের সমর্থনকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে এবং ফিলিস্তিনে তাদের সামরিক আধিপত্যকে বাড়াবে।
গাজার মানবিক সংকট
গাজার মানুষদের উপর এই সামরিক অভিযান ও অস্ত্র ব্যবহারের প্রভাব মারাত্মক।
- স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংসের কাছাকাছি
- খাদ্য ও পানি সংকট
- হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারাচ্ছে
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং আন্তর্জাতিক কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (ICRC) বারবার সতর্ক করেছে যে, এই ধরনের সামরিক অভিযান মানবিক সংকটকে আরও বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং সংঘাত কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।
- আরব লীগ ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির সমালোচনা করেছে।
- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে চাপ দিচ্ছে, কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করতে পারে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন এ সব প্রতিক্রিয়াকে প্রায়শই ‘সামরিক নিরাপত্তার স্বার্থে’ উড়িয়ে দেয়।
বিশ্লেষণ: নতুন অস্ত্র চালান ও ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন এই অস্ত্র চালান:
- ইসরায়েলের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে
- গাজার পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও সংকটপূর্ণ করবে
- আন্তর্জাতিক শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে
এছাড়াও, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলাকালীন এমন অস্ত্র বিক্রি সংঘাতকে নতুন মাত্রা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের অস্ত্র বিক্রি কেবল সামরিক লক্ষ্য নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ৬৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি শুধু ইসরায়েলের সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রক্রিয়া, মানবিক পরিস্থিতি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করছে। গাজায় চলমান মানবিক সংকটের মধ্যে এই অস্ত্র চালান আরও আলোড়ন সৃষ্টি করবে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বের সমস্ত চোখ এখন গাজার দিকে, যেখানে মানবিক বিপর্যয় চলমান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি জটিল হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও মানবিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
MAH – 12901 I Signalbd.com