
তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করল চীন। ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে এই সিদ্ধান্ত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ ব্রহ্মপুত্রের ভাটির দেশগুলোতে।
চীনের মেগা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন
চীন বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে, যা ভারত ও বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। শনিবার এই মেগা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। বাঁধটির উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারিত হয়েছে ৬০ গিগাওয়াট, যা সম্পূর্ণ হলে চীনের ইয়াংসি নদীর ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’কেও ছাড়িয়ে যাবে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু তিব্বতের নয়, চীনের অন্যান্য অংশেও বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাঁচটি পৃথক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
প্রকল্পের পেছনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২০ সালে চীন এই প্রকল্পের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বেইজিং আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পকে ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে চীন। বেইজিং-এর লক্ষ্য, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা।
তিব্বতের মতো দূরবর্তী অঞ্চলে বিশাল অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত করতে চায়। পাশাপাশি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ভারতের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাঁধ নির্মাণের এই ঘোষণা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের জন্য। ব্রহ্মপুত্র ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী এবং কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত। চীনের এমন কার্যক্রমে পানি প্রবাহ কমে যেতে পারে এবং এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও কৃষি খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লি চীনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের উদ্বেগের কথা জানায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “চীনকে এমনভাবে প্রকল্পটি পরিচালনা করতে হবে যাতে নিচু অঞ্চলের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।” ভারত জানিয়েছে, তারা প্রকল্পটির ওপর নজর রাখছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার উদ্বেগ
চীনের এই মেগা প্রকল্প শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশকেও উদ্বিগ্ন করেছে। ব্রহ্মপুত্রের পানির উৎস চীনে থাকায় উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটির দেশগুলোতে পানির সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিকাজ, পানীয় জলের উৎস এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেকাংশেই এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন হলে তা শুধু কৃষি ও জল ব্যবস্থাপনাতেই নয়, ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনেও রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে ভারত-চীন এবং বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে।
পরিসংখ্যান ও তুলনা: কত বড় এই বাঁধ?
চীনের ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত, যার উৎপাদন ক্ষমতা ২২.৫ গিগাওয়াট। নতুন এই ইয়ারলুং জাংবো বাঁধের লক্ষ্য ৬০ গিগাওয়াট, যা বিদ্যমান সব প্রকল্পকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে তিব্বতের নিংচি অঞ্চলের মিডগ কাউন্টিতে, যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে কতজন মানুষকে স্থানচ্যুত হতে হবে, সে বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি চীনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না।
পরিবেশবিদদের উদ্বেগ ও বিশ্লেষকদের মত
পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, তিব্বতের মতো পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে এমন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এখানে হিমবাহ গলে আসা পানি থেকে গড়ে উঠেছে শত শত নদীর উৎস। সেই পানি শুধু চীন নয়, ভারত, বাংলাদেশ ও ভুটানের প্রায় ১৮০ কোটি মানুষকে সরবরাহ করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বাঁধ প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চীনের হাতে গেলে ভারত ও বাংলাদেশের কৌশলগত চাপ বাড়বে।
“ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের এমন বাঁধ নির্মাণ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও পানিস্বত্বকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।” — একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
সারসংক্ষেপ
চীনের নতুন মেগা বাঁধ প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশ উদ্বিগ্ন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে এটি চীনের একটি মাইলফলক হলেও এর পরিবেশগত ও কূটনৈতিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একত্রে বসে এই নদী ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত হিসাব রয়েছে, তা এখন পুরো অঞ্চলের জন্যই এক নতুন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে: ব্রহ্মপুত্রের ভবিষ্যৎ কার হাতে?
এম আর এম – ০৪১৪, Signalbd.com