পাকিস্তানের সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক’ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করল সৌদি আরব

বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা মানচিত্রে নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি সৌদি আরব এবং একমাত্র পরমাণু শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান রিয়াদে স্বাক্ষর করল এক ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের উপস্থিতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির মূল বক্তব্যে বলা হয়েছে— “যদি কোনো একটি দেশের ওপর আক্রমণ হয়, তবে সেটি উভয় দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে।” অর্থাৎ দুই দেশ যৌথভাবে প্রতিরক্ষার দায়ভার গ্রহণ করবে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী ঐক্য ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।
চুক্তির তাৎপর্য
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি শুধু প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক কাঠামো নয়; বরং মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।
- দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার ওপর নির্ভর করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটনের নীতি পরিবর্তন, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবের দুর্বলতা এবং আমেরিকার ‘একতরফা অবস্থান’ সৌদি নেতৃত্বকে বিকল্প শক্তি খুঁজতে বাধ্য করেছে।
- পাকিস্তানকে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে দেখছে রিয়াদ।
- পাকিস্তান শুধু একটি মুসলিম রাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বে সপ্তম পরমাণু শক্তিধর দেশ এবং তার সেনাবাহিনী বিশ্বের অন্যতম দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মুহূর্ত
রিয়াদের ঐতিহাসিক আল-ইয়ামামা প্রাসাদে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে ছিলেন:
- উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার,
- সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির,
- প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ,
- অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ ঔরঙ্গজেব।
সৌদি আরবের পক্ষ থেকে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানসহ শীর্ষ সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দুই দেশের নেতৃত্ব কৌশলগত অংশীদারিত্ব, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় যৌথ উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
মর্যাদাপূর্ণ অভ্যর্থনা
শাহবাজ শরীফ সৌদি যুবরাজের আমন্ত্রণে রিয়াদ সফরে গেলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
- সৌদি আকাশসীমায় প্রবেশের পর রয়্যাল সৌদি এয়ার ফোর্সের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান তার বিশেষ বিমানকে নিরাপত্তা দিয়ে এস্কর্ট করে।
- রিয়াদের কিং খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানো হয়।
- রাজধানীর প্রধান সড়কজুড়ে টাঙানো হয় পাকিস্তানের সবুজ পতাকা।
এই অভ্যর্থনা স্পষ্ট করে যে, সৌদি আরব পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
চুক্তি এমন এক সময়ে স্বাক্ষরিত হলো, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।
- ইয়েমেন সংকট, ইরান–সৌদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সিরিয়া ও লেবাননের জটিলতা—সব মিলিয়ে অঞ্চলের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ দিন দিন গভীর হচ্ছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে টানাপোড়েন এবং ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতিও এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
- চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতা সৌদি নেতৃত্বকে বহুমাত্রিক অংশীদারিত্বে অনুপ্রাণিত করছে।
এই অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা জোট কেবল সামরিক সহযোগিতাই নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে—মুসলিম বিশ্ব নিজের নিরাপত্তার দায়ভার নিজেরাই বহন করতে প্রস্তুত।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন নয়।
- ১৯৬০-এর দশক থেকেই পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টারা সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কাজ করছেন।
- ১৯৯০-এর দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সৌদি সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছিল।
- পাকিস্তানের কঠিন সময়ে সৌদি আরব আর্থিক সহায়তা দিয়েছে; অপরদিকে সৌদি আরবও পাকিস্তানি সেনাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করেছে।
এই ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় এবারের প্রতিরক্ষা চুক্তি দুই দেশের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় ভিত্তি দিল।
পাকিস্তানের কৌশলগত লাভ
১. আর্থিক সহযোগিতা – পাকিস্তান বর্তমানে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিরক্ষা চুক্তি দ্বিপাক্ষিক আস্থাকে আরও সুদৃঢ় করবে, ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
২. আন্তর্জাতিক অবস্থান – মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে এই জোট পাকিস্তানকে বৈশ্বিক কূটনীতিতে নতুন মর্যাদা দেবে।
৩. সামরিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ – চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সৌদি তেলভিত্তিক অর্থনীতি ও আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি থেকে লাভবান হতে পারবে।
সৌদি আরবের কৌশলগত লাভ
১. পারমাণবিক ছায়া – পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি সৌদি আরবকে একটি ‘ডিটারেন্স’ (প্রতিরোধ ক্ষমতা) দেবে। যদিও সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র ভাগাভাগির বিষয় নেই, তবে বিশ্বরাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
২. আঞ্চলিক নেতৃত্ব – মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম সেনাশক্তির সঙ্গে জোট সৌদি আরবকে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে সাহায্য করবে।
৩. নিরাপত্তা নিশ্চয়তা – ইয়েমেন ও পারস্য উপসাগরের চলমান সংকটে পাকিস্তানি সেনাদের অভিজ্ঞতা সৌদি প্রতিরক্ষায় বড় সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনার ঝড় উঠেছে।
- যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ সৌদি আরব দীর্ঘদিন আমেরিকার নিরাপত্তা নির্ভরশীল ছিল।
- চীন এ জোটকে স্বাগত জানাতে পারে, কারণ পাকিস্তান ও সৌদি—উভয়ের সঙ্গেই তাদের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
- ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, কারণ পাকিস্তান-সৌদি ঘনিষ্ঠতা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
- ইরানও এ বিষয়ে সতর্ক থাকবে, কারণ পাকিস্তান-সৌদি জোট আঞ্চলিক শক্তি প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা আনতে পারে।
সৌদি আরব–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি নিছক সামরিক সহযোগিতা নয়; এটি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক কূটনীতির নতুন বাস্তবতার প্রতিফলন। এই চুক্তি কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর। তবে এটুকু নিশ্চিত—মুসলিম বিশ্বের কৌশলগত শক্তি ভারসাম্যে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
MAH – 12880 Signalbd.com