ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত রামন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইসরাইল এবং ইয়েমেনের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হামলার ঘটনাটি ঘটে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হুথি বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তাদের ড্রোন লক্ষ্যভেদ করতে সফল হয়েছে।
হুথিদের বক্তব্য
হুথি সংগঠনের সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন:
“আমাদের উন্নত ড্রোন ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের রামন বিমানবন্দরে সঠিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। গাজায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ হামলা আমাদের সামরিক প্রতিক্রিয়া।”
হুথিরা আরও জানায়, ইসরাইল যতদিন ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাবে, ততদিন ইয়েমেন থেকে পাল্টা আঘাত আসতেই থাকবে।
ইসরাইলি প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ ড্রোনকে বিমানবন্দরের কাছাকাছি ভূপাতিত করেছে। ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, হামলার সময় বিমানবন্দরের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল, এবং কয়েকটি ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে।
রামন বিমানবন্দর কোথায় ও কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রামন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের ইলাত শহরের নিকটে অবস্থিত। এটি ইসরাইলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর কারণ এটি পর্যটন এবং সামরিক দিক থেকে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। গাজার কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় বিমানবন্দরটি প্রায়শই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে।
পেছনের প্রেক্ষাপট: গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন
গত কয়েক মাস ধরে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরাইলের এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলার ঘোষণা দিয়েছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে।
হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারা?
হুথিরা ইয়েমেনের একটি শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। বর্তমানে তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
হুথিদের মূল সমর্থক হিসেবে ইরানের নাম উঠে আসে, যদিও হুথিরা সরাসরি এ সম্পর্ক অস্বীকার করে। তারা ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থানকে তাদের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে।
আগের হামলার ইতিহাস
হুথিরা এর আগে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা সমুদ্রপথে ইসরাইলগামী জাহাজেও হামলা চালিয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো তারা ইসরাইলের একটি বড় বিমানবন্দরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করল।
ইসরাইলের পাল্টা হুমকি
হামলার পর ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক বিবৃতিতে হুথিদের সতর্ক করে বলেন:
“ইসরাইলের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেললে ইয়েমেন ফেরআউনের ১০ দুর্যোগের মতো শাস্তির সম্মুখীন হবে।”
এই হুমকি ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরাইল চাইলে ইয়েমেনে সরাসরি সামরিক অভিযান চালাতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের সূচনা করবে।
আঞ্চলিক প্রভাব: যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে
বিশ্লেষকরা বলছেন, হুথি হামলা শুধু একটি প্রতীকী আঘাত নয়; বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি ফ্রন্ট খুলে দিয়েছে। বর্তমানে ইসরাইল গাজায় ব্যস্ত, লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথেও সীমান্তে সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে ইয়েমেন থেকেও হামলা আসা ইসরাইলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনার পরপরই জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, “আমরা ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করি।”
অন্যদিকে ইরান হুথি হামলাকে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, “গাজায় ইসরাইলের অপরাধের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হুথিদের ড্রোন প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। তারা এমন ড্রোন ব্যবহার করছে যা দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম। ইয়েমেন থেকে ইসরাইল পর্যন্ত সরাসরি ড্রোন পাঠানো মানে তাদের সামরিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
তবে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Iron Dome, David’s Sling) বেশিরভাগ হামলা ঠেকাতে সক্ষম হলেও ১০০% নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ চিত্র
এই হামলার পর প্রশ্ন উঠেছে:
- ইসরাইল কি ইয়েমেনে পাল্টা হামলা চালাবে?
- হুথিরা কি আবারও বিমানবন্দর, বন্দর বা জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালাবে?
- মধ্যপ্রাচ্যে কি নতুন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হবে?
বিশ্লেষকদের মতে, যদি ইসরাইল ইয়েমেনে আঘাত হানে, তাহলে ইরান এবং সৌদি আরবের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এতে পুরো অঞ্চল নতুন সংকটে পড়তে পারে।
MAH – 12711, Signalbd.com



