
গাজা উপত্যকার মানবিক সংকট নিরসনে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর “সুমুদ ফ্লোটিলা”-তে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হামলা এবং জাহাজ জব্দের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে একাধিক দেশ। অনেকে সরাসরি ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
মালয়েশিয়ার কঠোর ভাষার নিন্দা
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার ইব্রাহিম ইসরায়েলি বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে “অমানবিক” বলে অভিহিত করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন—
“নিরস্ত্র বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর বলপ্রয়োগ এবং গাজার নিরীহ জনগণের জন্য জীবনরক্ষাকারী ত্রাণ সামগ্রী বহনকারী জাহাজকে জব্দ করা কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সামুদ্রিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
আনোয়ার ইব্রাহিম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ঘটনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
তুরস্কের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবি
ত্রাণবাহী নৌবহরে আটক হওয়া কয়েকজন তুর্কি নাগরিকের মধ্যে বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী রয়েছেন। এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তুরস্ক সরকার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক আমাদের নাগরিক ও অন্যান্য মানবাধিকারকর্মীদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানাই যেন তারা ইসরায়েলের এই বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা নেয়।”
তুরস্ক অতীতেও ফ্লোটিলা ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে তীব্র কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। ২০১০ সালে গাজাগামী “মাভি মারমারা ফ্লোটিলা”-তে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নয়জন তুর্কি নিহত হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়েছিল। সাম্প্রতিক এই ঘটনা আবারো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিলো।
আয়ারল্যান্ডের উদ্বেগ
ইউরোপীয় দেশ আয়ারল্যান্ডও এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন—
“আমরা ইসরায়েলের কাছে জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছি, আটককৃত স্বেচ্ছাসেবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে তাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়া হোক।”
আয়ারল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে। দেশটির সংসদ একাধিকবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব পাস করেছে।
লাতিন আমেরিকার প্রতিক্রিয়া
ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়া—দুই লাতিন দেশও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট বলেন—
“মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার ইসরায়েলের নেই। এ ধরনের আগ্রাসী আচরণ বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।”
কলম্বিয়াও জাহাজ জব্দ ও হামলার নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিক্ষোভে উত্তাল গ্রিস, আর্জেন্টিনা ও তিউনিশিয়া
ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমেছে বিভিন্ন দেশের মানুষ। আর্জেন্টিনা, গ্রিস ও তিউনিশিয়ার রাজধানীতে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। হাতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দিয়েছে এবং আটক স্বেচ্ছাসেবীদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক মানবাধিকারকর্মী বলেন—
“আমরা চাই গাজার নিরীহ মানুষদের কাছে অবিলম্বে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হোক। ইসরায়েল যদি মানবিক সহায়তাকে অবরুদ্ধ করে, তবে এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জাজনক।”
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিবও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “মানবিক সহায়তা বহনকারী জাহাজে হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।” জাতিসংঘ ইতিমধ্যে ইসরায়েলের কাছে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা চেয়েছে এবং আটক স্বেচ্ছাসেবীদের মুক্তি দিতে আহ্বান জানিয়েছে।
ফ্লোটিলা অভিযানের পটভূমি
গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি অবরোধের শিকার। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির মারাত্মক সংকটে পড়েছে স্থানীয় মানুষ। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকারকর্মীরা ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠিয়ে আসছে।
সুমুদ ফ্লোটিলা মূলত একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসা সামগ্রী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গাজায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রায়ই ইসরায়েলি নৌবাহিনী এসব জাহাজকে আটক করে।
আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের আঞ্চলিক জলসীমার বাইরে মানবিক সহায়তাবাহী জাহাজে হামলা চালানো বা জব্দ করা বেআইনি। তবে ইসরায়েল দাবি করে, গাজার দিকে যাওয়া এসব জাহাজ হামাসের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিতে পারে। এ যুক্তিতে তারা প্রায়ই এ ধরনের অভিযান চালায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণ ছাড়াই ইসরায়েলের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী।
বিশ্লেষকদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের এ ধরনের হামলা কেবল গাজায় মানবিক সহায়তা ব্যাহত করছে না, বরং বৈশ্বিক পরিসরে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ইতিমধ্যে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপের কথা ভাবছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক ড. সামির আহমেদ বলেন—
“ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজার ওপর অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।”
গাজাগামী সুমুদ ফ্লোটিলা-তে ইসরায়েলি হামলা শুধু মানবিক সহায়তাকে বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, আয়ারল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, গ্রিস, আর্জেন্টিনা, তিউনিশিয়া—সব জায়গায় চলছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সবাই একই সুরে বলছে—মানবিক সহায়তাকে লক্ষ্যবস্তু বানানো চলতে পারে না।
এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল তার অবস্থান পরিবর্তন করে কি না, নাকি আগের মতোই গাজার অবরোধ কঠোরভাবে জারি রাখবে।
MAH – 13123 I Signalbd.com