গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ শুধু সাধারণ মানুষের জীবনই কেড়ে নিচ্ছে না, বরং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জীবনকেও গভীর সংকটে ফেলেছে। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, গত ২২ মাসে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৭০ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া পেশাজীবী নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১৩ জন সাংবাদিক জীবন হারাচ্ছেন।
এই তথ্য নিশ্চিত করেছে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ShireenDotPS, যা বিখ্যাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলাহ-এর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত। ২০২২ সালে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন শিরিন আবু আকলাহ। তাঁর হত্যার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ নতুন মাত্রা পায়।
৭ অক্টোবরের পর থেকে সাংবাদিকদের জন্য গাজা মৃত্যুপুরী
আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ওই দিন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে, যার মধ্যে সাংবাদিকদের লক্ষ্য করেও বহু হামলা হয়েছে। CPJ জানাচ্ছে, সাংবাদিকদের হত্যার কারণে গাজায় “সংবাদশূন্যতা” (Information Blackout) তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের অনেক তথ্য গোপন করে দিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমগুলো সাধারণত গাজা থেকে তথ্য পেতে স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে সেসব সাংবাদিক প্রতিনিয়ত হামলা, গ্রেপ্তার, অপহরণ ও হত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
সাংবাদিকরা কেন টার্গেট?
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, শুধু সাংবাদিকদের হত্যা নয়, ইসরায়েল “সাংবাদিকতাকেই ধ্বংসের চেষ্টা করছে”। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে:
“ইসরায়েল সাংবাদিকদের হত্যা করছে এবং তাদের কাজে বাধা দিচ্ছে, যাতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করা না যায়।”
অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইতিমধ্যেই এ ঘটনাকে “যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়, তবু হামলা বন্ধ নয়
গত জুন মাসে CPJ সহ ৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা কেবল তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য জীবন দিচ্ছেন। চিঠিতে উল্লেখ ছিল:
“তারা শুধু সত্য প্রকাশের জন্য কাজ করছেন। কিন্তু সেই সত্য প্রকাশের জন্য প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন।”
জাতিসংঘও একাধিকবার সাংবাদিকদের সুরক্ষার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু নিন্দা ও সমালোচনার পরও হামলা অব্যাহত রয়েছে।
গাজায় সাংবাদিকদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ?
গাজা এখন বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক জায়গা সাংবাদিকদের জন্য। আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী:
✔ সাংবাদিকরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্র কভার করতে গিয়ে নিহত হচ্ছেন না, অনেক সময় তাদের পরিবারসহ টার্গেট করে বোমা হামলা চালানো হচ্ছে।
✔ সাংবাদিকদের ব্যবহৃত গাড়ি ও ক্যামেরায় “PRESS” লেখা থাকা সত্ত্বেও তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে।
✔ ইন্টারনেট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বারবার বন্ধ হওয়ায় সাংবাদিকরা তথ্য প্রেরণে গুরুতর সমস্যায় পড়ছেন।
সাংবাদিকদের পরিবারও নিরাপদ নয়
শুধু সাংবাদিকরাই নয়, তাদের পরিবারের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। অনেক সাংবাদিক পরিবারসহ মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তারা পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক আইন কী বলে?
জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। সাংবাদিকদের নাগরিক ব্যক্তি (Civilian) হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের ওপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।
কেন বিশ্ব এখনো নীরব?
বিশ্বব্যাপী কিছু প্রতিবাদ হলেও বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সাংবাদিকদের সুরক্ষার বিষয়ে প্রস্তাব উঠলেও তা কার্যকর হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এমন নীরবতা বজায় রয়েছে।
আল জাজিরা কী বলছে?
আল জাজিরা জানিয়েছে, তারা সাংবাদিক হত্যার ঘটনা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে। সংস্থাটি মনে করে, ইসরায়েলের এই কৌশল সাংবাদিকদের ভয় দেখিয়ে সত্য গোপন করার চেষ্টা। আল জাজিরা আরও জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক।
গণমাধ্যমের দাবি: অবিলম্বে সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক
বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি:
✔ গাজায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
✔ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে মাঠে নেমে কাজ করতে হবে।
✔ সাংবাদিকদের হত্যা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গাজায় সাংবাদিকদের ওপর ধারাবাহিক হামলা কেবল সাংবাদিকতার জন্য নয়, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের জন্যও বড় হুমকি। যদি বিশ্ব এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সত্য ও তথ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে।
MAH – 12450 , Signalbd.com



