‘গাজায় সামরিক অভিযান ছাড়া নেতানিয়াহুর পক্ষে সরকার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়’

ইসরায়েলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মারিভ ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান ছাড়া নেতানিয়াহুর পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা গত কয়েক মাস ধরে তলানিতে নেমে গেছে। দুর্নীতির অভিযোগ, অর্থনৈতিক সংকট, এবং সরকারের ভিতরে বিভক্তি—সবকিছু মিলিয়ে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে গাজায় নতুন করে সামরিক অভিযান চালিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করতে চাইছেন।
কেন সামরিক অভিযান ছাড়া নেতানিয়াহুর সরকার টিকছে না?
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বর্তমানে একটাই বড় ইস্যু—গাজা ও হামাস। দেশটির ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, হামাসকে সম্পূর্ণ দমন না করা পর্যন্ত ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এই অবস্থায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিরোধীরা অভিযোগ করছে যে, তিনি হামাসের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা করছেন।
তবে মারিভ পত্রিকা বলছে, সামরিক বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, নেতানিয়াহু নিজেও জানেন যে গাজায় অভিযান ছাড়া তার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা অসম্ভব। কারণ ইসরায়েলি সমাজে যুদ্ধকে এখন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুদ্ধ মানেই জাতীয়তাবাদী আবেগ বৃদ্ধি, আর সেটিই নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য।
আল জাজিরার বিশ্লেষণ – নেতানিয়াহুর শেষ চেষ্টার যুদ্ধ?
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, নেতানিয়াহু বলেছেন তিনি তার ক্ষমতার ‘শেষ পর্যন্ত’ সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে চান। এর মানে হলো, তিনি বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে বের হতে চান একটি ‘চূড়ান্ত সামরিক পদক্ষেপ’ গ্রহণের মাধ্যমে।
তবে এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এক রূপরেখা দিয়েছেন ভবিষ্যতে সম্ভাব্য শান্তি আলোচনার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র চায় না যে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হোক, কারণ এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
হামাসের অবস্থান – আপস করেও কেন যুদ্ধের শঙ্কা?
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইতিমধ্যেই নেতানিয়াহুর অনেক শর্ত মেনে নিয়েছে। বিশেষ করে ১০ জন ইসরায়েলি জীবিত বন্দিকে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি হামাসের পক্ষ থেকে সম্মতি দেওয়া হয়েছে।
তবুও নেতানিয়াহু নতুন নতুন শর্ত দিচ্ছেন। যেমন—গাজায় হামাসের সামরিক শক্তি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা, নতুন নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর, এবং সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদী ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ। হামাসের পক্ষ থেকে এসব শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব না। ফলে যুদ্ধ এড়ানো যাচ্ছে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি – নতুন যুদ্ধের কাউন্টডাউন শুরু
ইসরায়েলি সামরিক সূত্র বলছে, সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই গুরুতরভাবে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিজার্ভ বাহিনীকে মোতায়েনের সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় সেনা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং আকাশপথে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব কাছেই।
গাজায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযান – কী হতে পারে এর ফলাফল?
যদি ইসরায়েল পূর্ণমাত্রায় গাজায় আক্রমণ চালায়, তবে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষ বিপদের মুখে পড়বেন। আগের যুদ্ধগুলোতে যেমন দেখা গেছে, বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি হয়।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ভিতরে রকেট হামলা ও আত্মঘাতী হামলার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং এর পরিণতি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা – যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাতিসংঘের উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় রাখতে তাদের বড় ভূমিকা আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে জানানো হয়েছে, তারা ইসরায়েলকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলছে, তবে সরাসরি কোনো চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা কম।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, “নতুন যুদ্ধ হলে তা মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে।”
ইসরায়েলের রাজনৈতিক সংকট ও নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ
নেতানিয়াহু বর্তমানে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী। তবে দুর্নীতির অভিযোগ, বিচারিক সংস্কার নিয়ে আন্দোলন, এবং সাম্প্রতিক নিরাপত্তা সংকট তার অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ শুরু না করেন, তবে তার ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি খুব বেশি। অন্যদিকে যুদ্ধ শুরু হলেও যদি তা সফল না হয়, তবে তার জন্য সেটি হবে রাজনৈতিক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
গাজা যুদ্ধ – মানবিক বিপর্যয়ের নতুন অধ্যায়?
পূর্বের যুদ্ধগুলোতে দেখা গেছে, গাজায় হামলার ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়েছে। যদি নতুন যুদ্ধ শুরু হয়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই সতর্ক করছে যে, গাজার সাধারণ মানুষ আবারও সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হবে।
সর্বশেষ বিশ্লেষণ:
- নেতানিয়াহু রাজনৈতিক চাপে আছেন।
- গাজায় হামলা ছাড়া তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা কঠিন।
- হামাস শর্ত মেনে নেওয়ার পরও নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
- ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রস্তুত।
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, গাজা উপত্যকায় নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা প্রবল, আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
MAH – 12448 , Signalbd.com