গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে রক্তের সাগর
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে প্রায় দুই বছর ধরে। প্রতিদিনই সেখানে রক্ত ঝরছে, ভেঙে পড়ছে স্বপ্ন, ভস্মীভূত হচ্ছে হাজারো ঘরবাড়ি। সর্বশেষ সরকারি তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো—এর মধ্যে অন্তত ১৯ হাজার শিশু প্রাণ হারিয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা এটিকে বলছেন “সভ্যতার জন্য এক ভয়াবহ কলঙ্ক”।
জাতিসংঘ: “শিশুদের কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই”
গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় এই হতাহতের তথ্য প্রকাশ করার পর আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (UNRWA) জানিয়েছে—গাজায় শিশুদের জন্য এখন কোনো নিরাপদ স্থান নেই। যুদ্ধের শুরু থেকে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ (UNICEF) জানিয়েছে, মাত্র পাঁচ মাসে গড়ে প্রতিদিন ৫৪০ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে শিশু হত্যার সবচেয়ে ভয়াবহ পরিসংখ্যানগুলোর একটি।
রক্তাক্ত বাস্তবতার ছবি
আল জাজিরা সম্প্রতি একটি হৃদয়বিদারক ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, মাত্র ১২ বছরের শিশু আমনা আল-মুফতি পরিবারের জন্য পানি আনতে বের হয়েছিল। হঠাৎই ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারায় সে। ভিডিওতে ধরা পড়ে বাবার অসহায় কান্না—যা গাজার শিশুদের দুর্বিষহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
নতুন হামলায় আরও হতাহতের মিছিল
জাতিসংঘের সতর্কবার্তার মধ্যেই মঙ্গলবার ভোর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও আক্রমণ চালায়। এতে অন্তত ৫১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আটজন ছিলেন সাধারণ মানুষ, যারা খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। শুধু মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের হামলায় প্রায় দুই হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
গাজার খান ইউনিস এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে বিমান হামলা চালিয়ে অন্তত আটজনকে হত্যা করা হয়। একই দিনে মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ অঞ্চলে আরেকটি তাঁবুতে বোমা বর্ষণ করে আরও চারজনের মৃত্যু হয়।
গাজা: ধ্বংসস্তূপের নগরী
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজা কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, বাজার—কোনো স্থানই নিরাপদ নেই। খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখো মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। হাসপাতালে ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানির অভাব চরমে। প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন মৃত্যু, অনাহার ও বাস্তুচ্যুতির শিকার।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ”
মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্পষ্টভাবে বলছে—শিশুদের এভাবে হত্যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই গণহত্যার মামলা দায়ের করেছে বিভিন্ন সংস্থা। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু বড় শক্তির রাজনৈতিক সমর্থন পেয়ে ইসরায়েল নির্বিঘ্নে তার সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের শুরুর প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরুতে হামাসকে লক্ষ্যবস্তু করলেও দ্রুতই হামলার লক্ষ্য হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ শুরু হয়। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে গাজার জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে।
বিশ্বের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ, মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু রাষ্ট্র গাজার এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, জাকার্তাসহ নানা শহরে লাখো মানুষ মিছিল করেছে “স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা” স্লোগান নিয়ে। তবে বিশ্বশক্তির রাজনৈতিক বিভাজন ও স্বার্থের কারণে কার্যকর কোনো সমাধান আসেনি।
শিশু হত্যার করুণ পরিসংখ্যান
ইতিহাসবিদরা বলছেন, একসাথে এত সংখ্যক শিশুর মৃত্যু মানব ইতিহাসে বিরল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কিংবা ইরাক যুদ্ধ—কোথাও এত দ্রুত সময়ে এত শিশু নিহত হয়নি। প্রায় ১৯ হাজার শিশু হত্যাকাণ্ড এই যুদ্ধকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান
জাতিসংঘ বারবার অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এখনো তা উপেক্ষা করছে। গাজার মানুষের কান্না, ধ্বংসস্তূপ আর শিশুদের রক্তাক্ত দেহ পৃথিবীর বিবেককে নাড়া দিলেও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
গাজা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের নাম। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ যুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, গোটা মানবসভ্যতার জন্য কলঙ্ক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিশু হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে চিরকাল রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো—মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মানবতার কথা বলা বিশ্বশক্তিগুলো কি এই রক্তপাত থামাতে এগিয়ে আসবে, নাকি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে?
MAH – 12420 , Signalbd.com



