রাজনীতি

নির্বাচন কমিশন এখন বিভক্ত: এনসিপি নেতা হাসনাতের অভিযোগ

Advertisement

জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এনসিপির (ন্যাশনাল কনসেন্সাস পার্টি) দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রধান সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর সাম্প্রতিক মন্তব্য। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এখন ভাগাভাগি ও প্রভাবিত অবস্থায় রয়েছে। শনিবার (১ নভেম্বর) সকালে বরগুনায় দলীয় কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে আয়োজিত এক সমন্বয় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।

হাসনাত বলেন,
“নির্বাচন কমিশন যে দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল, তা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। কমিশন নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত স্বার্থে।”

“নির্বাচনী প্রতীক বণ্টনে স্বচ্ছতা নেই”

এনসিপি নেতা অভিযোগ করেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক সংযুক্তিকরণ ও বণ্টনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে মধ্যযুগীয় কায়দায়। তিনি বলেন,
“নির্বাচন কমিশন বর্তমানে প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা রক্ষা করতে পারছে না। কোন দল পাবে কোন প্রতীক, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। এটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক সংকেত।”

হাসনাত আরও বলেন, “আমরা যদি এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক না পাই, তবে নির্বাচন কমিশনকে এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে।”
তার মতে, রাজনৈতিক প্রতীক কোনো দলের পরিচয় ও অস্তিত্বের প্রতিফলন। “একটি দলের প্রতীক কেড়ে নেওয়া মানে তার পরিচয় কেড়ে নেওয়া,” বলেন তিনি।

স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

সভায় উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাসনাত বলেন, “নির্বাচন কমিশন এখন এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেন এটি একটি প্রশাসনিক বিভাগ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নয়।”
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়তো জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নাও হতে পারে।

তার ভাষায়,
“নির্বাচন কমিশনের অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে স্বেচ্ছাচারীভাবে। তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে স্বাধীন কোনো সংস্থা নয়, বরং কারও নির্দেশে কাজ করছে।”

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে টালবাহানা

হাসনাত অভিযোগ করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল টালবাহানা করছে।
তিনি বলেন, “জুলাই সনদের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্যমতের ভিত্তি গড়ে ওঠার কথা ছিল, কিন্তু আজ তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং নানা অজুহাতে বিলম্ব ঘটানো হচ্ছে।”

তার মতে, এই সনদ বাস্তবায়ন হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হতো। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

“৫ আগস্টের আগে জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্র ছিল”

অতীতের প্রসঙ্গ টেনে হাসনাত বলেন, “৫ আগস্টের আগে দেশ ছিল এক জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্রে পরিণত। তখন প্রশাসন ও সরকারে জবাবদিহিতা ছিল না। জনগণের মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আজও যদি নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ না করে, তবে সেই জবাবদিহিতাহীনতা আবার ফিরে আসবে।”

বরগুনায় দলের সমন্বয় সভা: উপস্থিত ছিলেন শীর্ষ নেতারা

বরগুনার জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত ওই সমন্বয় সভায় এনসিপির কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
সভায় দলীয় কার্যক্রম, সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন এনসিপির বরগুনা জেলা সভাপতি মফিজুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন জেলা সাধারণ সম্পাদক শহীদুল রহমান, যুগ্ম সম্পাদক সেলিম রেজা, এবং নারী সংগঠক রেহানা পারভীনসহ আরও অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হাসনাত আব্দুল্লাহর এই বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে বিভিন্ন দলের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হোসেন বলেন,
“নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারানো মানে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। তাই কমিশনকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।”

নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া

এদিকে নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন,
“নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। প্রতীক বরাদ্দের বিষয়টি কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী হচ্ছে। কোনো দল বা ব্যক্তির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হচ্ছে না।”

তবে নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি এখনো পাওয়া যায়নি।

জনগণের প্রতিক্রিয়া: আস্থার সংকট বাড়ছে

বরগুনা ও আশপাশের এলাকায় জনগণের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে—আসন্ন নির্বাচন কি সত্যিই নিরপেক্ষ হবে?
স্থানীয় ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন,
“আমরা চাই সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, কিন্তু যদি কমিশন পক্ষপাত করে, তাহলে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাবে।”

একই মত প্রকাশ করেন কলেজছাত্রী ফারজানা আক্তার। তিনি বলেন,
“যদি আগেই ঠিক হয়ে যায় কে জিতবে, তাহলে ভোট দেওয়ার মানে কী?”

রাজনৈতিক অচলাবস্থার আশঙ্কা

বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি অবিশ্বাস যদি আরও বাড়ে, তবে তা রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন,
“নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষা করতে না পারলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনই সময় কমিশনের নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করার।”

গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে আস্থার পরিবেশ দরকার

এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যের মূল সুর ছিল—গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন,
“আমরা চাই একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন। কমিশন যদি বিভক্ত হয়, তাহলে সেই নির্বাচন কোনোদিনই গ্রহণযোগ্য হবে না।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বিতর্কগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা কিছুটা নড়বড়ে হয়েছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর মন্তব্য সেই উদ্বেগ আরও উস্কে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আসন্ন নির্বাচন কি সত্যিই হবে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক, নাকি আবারও অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বে ঘেরা এক রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হবে?

MAH – 13577 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button