গাজা উপত্যকায় চলমান মানবিক সংকট এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে অনেক ফিলিস্তিনি আজ আর পায়ে হেঁটে ত্রাণ কেন্দ্রে যাওয়ারও সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল (ডিআরসি) এক বিশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই করুণ বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
ডিআরসি’র সর্বশেষ মূল্যায়নে চরম মানবিক সংকটের চিত্র
ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল তাদের গাজা কার্যক্রমের সমন্বয়কারী এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা এমন অনেক পরিবার পেয়েছি, যারা টানা কয়েকদিন ধরে কিছু খায়নি। তাদের শরীরে এতোটাই দুর্বলতা এসেছে যে ত্রাণ গ্রহণের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের শারীরিক অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। তারা নিজেদের যত্ন নিতেও অক্ষম হয়ে পড়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের কোলে করে নিয়ে আসার মতো শক্তিও অভিভাবকদের নেই।
গাজার ভয়াবহ অবস্থা: খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সংকট তীব্রতর
ইসরায়েলি অভিযানের কারণে গাজার অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। মানবিক সহায়তা সরবরাহে জড়িত সংস্থাগুলোর চলাফেরায় রয়েছে কড়া নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতা।
উত্তর গাজায় বসবাসরত প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটও ভয়াবহ। অনেক এলাকা এক মাসের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবা পায়নি। এমন অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সহায়তাও পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের প্রভাব: সহায়তা কার্যক্রমে স্থবিরতা
ডিআরসি জানায়, তাদের মতো অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গাজায় প্রবেশাধিকার, নিরাপদ চলাচল ও মানবিক উপকরণ সরবরাহের অনুমতি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধ ও অবরোধের ফলে ত্রাণবাহী যানবাহন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। কোনো এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের তা গ্রহণ করার মতো শারীরিক শক্তি নেই, যা পুরো মানবিক উদ্যোগকে চরম দুর্দশায় ফেলে দিচ্ছে।
দীর্ঘ সময়ের অবরোধ ও চলমান যুদ্ধের ফলাফল
গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ এবং বারবার সংঘর্ষের শিকার। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান সর্বশেষ যুদ্ধ গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের নতুন অধ্যায় লিখছে। স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র সবই ধ্বংস হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাপী সহানুভূতির আবেদন করলেও বাস্তব সহায়তা প্রায় অপ্রতুল। বিভিন্ন দাতা সংস্থা সীমিত পরিসরে কাজ করলেও অব্যাহত হামলা ও নিরাপত্তাহীনতা তাদের গতিবিধিকে সীমিত করেছে।
দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ বিপর্যয়
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, গাজায় যদি দ্রুত এবং যথেষ্ট মাত্রায় সহায়তা পৌঁছানো না যায়, তাহলে সেখানে গণদুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি ও শিশুমৃত্যুর হার মারাত্মকভাবে বাড়বে।
একজন মানবিক সাহায্য বিশ্লেষক বলেন, “গাজার মানুষ এখন নিছক বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা উন্নয়ন—এই শব্দগুলো এখন তাদের জীবনে বিলাসিতা। জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
“আমরা এমন পরিবার পেয়েছি, যারা টানা কয়েকদিন কিছু খায়নি, তাদের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি নেই”—ডিআরসি’র গাজা কর্মসূচি সমন্বয়কারী।
মানবিক সহায়তা নয়, এখন প্রয়োজন জীবন রক্ষার জরুরি পরিকল্পনা
গাজার বর্তমান বাস্তবতা কেবল একটি রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং একটি মানবিক বিপর্যয়েরও প্রতিচ্ছবি। ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা গোটা বিশ্বের জন্য একটি জাগরণের ঘণ্টা।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এখনই একসঙ্গে গাজা উপত্যকার জনগণের পাশে দাঁড়ানো। সময় মতো সহায়তা না পৌঁছালে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
এম আর এম – ০৬৯৮, Signalbd.com



