বিশ্ব

খাবারের সন্ধানে ৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে চোখে গুলি খেল ফিলিস্তিনি কিশোর

Advertisement

গাজায় খাবারের জন্য জীবন হাতে নিয়ে পথে নামতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তেমনই এক ১৫ বছরের কিশোর আব্দুল রহমান আবু জাজার, যিনি রাতের আঁধারে ত্রাণ সংগ্রহে গিয়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসকরা বলছেন, তার বাঁ চোখে আর দৃষ্টিশক্তি ফিরবে না।

গুলিতে চোখ হারাল ১৫ বছরের কিশোর

ইসরায়েলের অবরোধ আর টানা হামলায় বিপর্যস্ত গাজা উপত্যকা। খাদ্যের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ১৫ বছরের কিশোর আব্দুল রহমান আবু জাজার ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতে নিজের জীবন বাজি রেখে গিয়েছিলেন খাবার আনতে। কিন্তু ফিরলেন চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, তার বাঁ চোখে আর আলো ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ঘটনার বিস্তারিত: ত্রাণ পেতে গিয়ে গুলির শিকার

ঘটনাটি ঘটেছে রাত ২টার দিকে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অনাহারে থাকা আবু জাজার গিয়েছিলেন গাজার আল-মুনতাজাহ পার্ক এলাকায় একটি খাদ্য বিতরণ পয়েন্টে। প্রায় ৫ ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছান সেখানে। তখন তিনি ছিলেন আরও তিনজনের সঙ্গে। হঠাৎই সেখানে গুলি শুরু হয়।

আবু জাজার বলেন, “আমরা দৌড়াচ্ছিলাম, তখনই গুলি শুরু হয়। হঠাৎ শরীরজুড়ে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো অনুভব করি, তারপর পড়ে যাই। মনে হচ্ছিল, আমি মারা যাচ্ছি।”

তার সঙ্গে থাকা অন্য তিনজনও গুলিবিদ্ধ হন। আশপাশে থাকা মানুষদের সহায়তায় জ্ঞান ফিরলে তিনি জানতে পারেন, গুলিটি তার চোখে লেগেছে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, বাঁ চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চিকিৎসকের বক্তব্য: দৃষ্টিশক্তি ফেরার সম্ভাবনা নেই

চিকিৎসকদের মতে, গুলিটি সরাসরি আবু জাজারের চোখে ঢুকে যায়। মোবাইল ফোনের আলো তার চোখের সামনে ধরেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অপারেশনের পরও চিকিৎসকেরা হতাশার সুরে জানান, “তার বাঁ চোখে কোনো আলো ফেরার সম্ভাবনা নেই।”

তবে আবু জাজার এখনও আশাবাদী। তার ভাষায়, “আল্লাহ চাইলে আমার দৃষ্টি ফিরে আসবে।”

গাজায় মানবিক বিপর্যয়

গাজায় এখন কার্যত দুর্ভিক্ষ চলছে। ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের অবরোধ এবং চলমান সংঘর্ষের ফলে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব চরম আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৬ হাজারের বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।

শুধু গত রবিবারেই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৯২ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ৫৬ জনই ছিলেন ত্রাণ সংগ্রহ করতে যাওয়া মানুষ। এই পরিসংখ্যান দিনকে দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

ত্রাণ নিতে গেলেও মিলছে গুলি

গাজার বিভিন্ন খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে গুলি চালানোর ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত। গ্লোবাল হিউম্যান ফাউন্ডেশন পরিচালিত বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সহায়তা নিতে আসা সাধারণ মানুষ প্রায়ই গুলির শিকার হচ্ছেন।

একজন স্থানীয় সাংবাদিক জানিয়েছেন, “মানুষ এখন ত্রাণ নিতে গেলেও গুলিতে মারা পড়ছে। এক বস্তা গমের আটা বা একটি খাবারের প্যাকেট এখন সাধারণ মানুষের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহযোগিতার ঘাটতি

জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো ত্রাণ পাঠানোর চেষ্টা করলেও ইসরায়েলি সীমান্তে আটকে রয়েছে প্রায় ২২ হাজারের বেশি ট্রাক। শনিবার মাত্র ৩৬টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পেরেছে।

জাতিসংঘ বলছে, মে মাসে ত্রাণ কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি সাহায্য নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন।

শিশুদের দুর্দশা: অপুষ্টি ও মৃত্যুর মিছিল

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, চলমান সংকটে মৃত ১৭৫ জনের মধ্যে ৯৩ জনই শিশু। এরা সবাই অপুষ্টি ও খাদ্যের অভাবে প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের গ্লোবাল নিউট্রিশন ক্লাস্টার জানাচ্ছে, পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: এটি পরিকল্পিত অবরোধ

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস দাবি করছে, ইসরায়েলের এই কার্যকলাপ একটি পরিকল্পিত “ক্ষুধা, অবরোধ ও বিশৃঙ্খলার কাঠামোগত অভিযান”। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকও একমত, এটি শুধু যুদ্ধ নয় — বরং একটি জনসংখ্যাকে ধ্বংস করার এক নির্মম কৌশল।

কবে থামবে এই মানবিক বিপর্যয়?

খাবারের সন্ধানে ১৫ বছরের একটি কিশোরকে চোখে গুলিবিদ্ধ হতে হচ্ছে — এটি কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, এটি গাজার বর্তমান বাস্তবতার একটি নির্মম প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন উঠছে, জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায় কতদিন চোখ বুজে থাকবে? আর কত কিশোর, আর কত শিশু এমন করুণ পরিণতির শিকার হবে?

এম আর এম – ০৬৯৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button