অর্থনীতি

সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় ভেটকি মাছ চাষে সাফল্য

Advertisement

উচ্চ পুষ্টিগুণ, সুস্বাদু স্বাদ এবং বাণিজ্যিক মূল্যের কারণে ‘ভেটকি’ বা কোরাল মাছ বাংলাদেশের বাজারে এক বিশেষ অবস্থান তৈরি করেছে। তবে এতদিন ধরে এ মাছের চাষ ছিল সীমিত, বিশেষত উপযুক্ত পোনা এবং কৃত্রিম খাদ্যের অভাব থাকায়। এবার সেই সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষণা। সমুদ্রের বুকেই ভাসমান খাঁচায় কৃত্রিম সম্পূরক খাদ্যে ভেটকি চাষ করে গবেষকেরা পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

গবেষণার পেছনের গল্প

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ (SCMFP)-এর আওতায় মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এই গবেষণা চালিয়েছেন বাকৃবির ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান এবং তাঁর সহকারী, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জাবেদ হাসান।

গবেষণার মাঠপর্যায়ের কাজ হয়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়—সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং ভোলার চর কুকরি-মুকরিতে। গবেষণায় প্রথমে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলেছে নার্সিং পর্যায়, এরপর সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় ভেটকি বড় করার কাজ।

উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য

গবেষণা শেষে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি খাঁচা থেকে বছরে ৮০০ থেকে ৮৫০ কেজি পর্যন্ত ভেটকি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে উৎপাদন হয়েছে ১৩ থেকে ১৭ কেজি, যা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, পুকুর বা ঘেরে প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ ১৫০০ কেজি উৎপাদন হলেও খাঁচায় চাষে জায়গা সাশ্রয় করে অধিক ফলন সম্ভব হয়েছে।

খাঁচায় চাষ করা ভেটকির গড় আমিষের পরিমাণ ছিল ১৯ গ্রাম, যা সাধারণত বাজারে পাওয়া কোরালের তুলনায় বেশি (১৭ গ্রাম)। এতে বোঝা যায়, কৃত্রিম খাদ্যে মাছের পুষ্টিগুণে কোনো ক্ষতি হয়নি।

অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক

গবেষণার ফলাফল বলছে, প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগে প্রায় ১.৭০ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব হচ্ছে খাঁচায় ভেটকি চাষে। জমিভাড়া না লাগা, কম পরিমাণে খাদ্য অপচয় এবং খাঁচার দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারযোগ্যতা (৫-৭ বছর) একে আরও লাভজনক করে তুলেছে।

বর্তমানে প্লাস্টিকের খাঁচা ব্যবহার হলেও প্রান্তিক চাষিরা চাইলে বাঁশ কিংবা সস্তা জাল দিয়েও এই খাঁচা তৈরি করতে পারেন, যা খরচ আরও কমিয়ে আনবে।

পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত সুবিধা

এই পদ্ধতিতে মাছের মধ্যে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি অনেক কম। একইসঙ্গে, মাছ একে অপরকে খেয়ে ফেলার সম্ভাবনাও নেই। সমুদ্রের ০ থেকে ৩৫ পিপিটি লবণাক্ত পানিতেও এই মাছ সহজে টিকে থাকতে পারে, যা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলকে চাষের জন্য এক আদর্শ এলাকা করে তুলেছে।

সামুদ্রিক মৎস্য খাতে নতুন দিগন্ত

অধ্যাপক শাহজাহান জানান, খাঁচায় ভেটকি চাষ কেবল মাছ উৎপাদন বাড়াবে না, বরং উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য নতুন আয়ের পথ খুলে দেবে। এতে করে দেশের ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সামুদ্রিক অর্থনীতির অংশগ্রহণও বাড়বে।

এই গবেষণা প্রমাণ করেছে, সামুদ্রিক মাছকে খাঁচায় ও কৃত্রিম খাদ্যে অভ্যস্ত করে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা পুরোপুরি সম্ভব। একদিকে যেমন জাতীয় পর্যায়ে মাছের উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ

গবেষণার সফলতা এখন মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় চাষিদের প্রশিক্ষণ, সহজে খাঁচা সরবরাহ, ভেটকির উন্নতমানের পোনা ও কৃত্রিম খাদ্য সহজলভ্য করা এখন প্রধান কাজ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং এনজিওদের সহযোগিতায় এ প্রযুক্তিকে পুরো উপকূলজুড়ে বিস্তার করা গেলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় টেকসই সমাধান

সমুদ্রের বুকেই ভেটকি চাষ করে বাংলাদেশের গবেষকেরা যে সাফল্য দেখিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে দেশের মৎস্য খাতের জন্য এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। টেকসই মেরিন অ্যাকুয়াকালচারের এই নতুন পথ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

পরিবেশবান্ধব, লাভজনক এবং প্রযুক্তিনির্ভর এই উদ্যোগ যদি যথাযথ পরিকল্পনায় ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে একে বাংলাদেশের “ব্লু রেভলিউশন”-এর অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button