
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো খুব শিগগিরই “জুলাই সনদ” নামের একটি ঐতিহাসিক দলিল স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এই সনদ মূলত সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কাঠামো নির্ধারণ করবে এবং এর লক্ষ্য হবে বাংলাদেশে আরেকজন স্বৈরশাসকের উত্থান ঠেকানো।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
২৪ সেপ্টেম্বর (বুধবার) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। বৈঠকের তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
শেহবাজ শরিফের সঙ্গে আলোচনায় ড. ইউনূস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রূপরেখা উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কারের এই উদ্যোগ দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাবে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ ‘জুলাই সনদ’?
‘জুলাই সনদ’ মূলত একগুচ্ছ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকারপত্র। এর মধ্যে রয়েছে—
- শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন
- দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহনশীলতা বৃদ্ধি
- সংসদ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
- ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা
- জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা
- স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন
ড. ইউনূস জানিয়েছেন, এই সনদ কার্যকর হলে রাজনৈতিক দলগুলো একটি যৌথ নীতিমালার ভিত্তিতে কাজ করবে এবং ক্ষমতার পালাবদলে সহিংসতার সংস্কৃতি কমে আসবে।
পাকিস্তানের বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বৈঠকে পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন ড. ইউনূস। শেহবাজ শরিফ জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় ঘন ঘন ঘটছে। দুই নেতা জলবায়ু ইস্যুতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। ইতিমধ্যে ১১টি জাতীয় কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার আলোচনায় রয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—
- নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
- স্বচ্ছ অর্থায়ন নীতি প্রণয়ন
- সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জোরদার করা
- দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, দলগুলো খুব শিগগিরই ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর করবে, যা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চুক্তি হিসেবে জায়গা করে নেবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সার্কের বিকল্প
আলোচনায় উঠে আসে যে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশই নতুন আঞ্চলিক সহযোগিতার পথ খুঁজছে। এর মাধ্যমে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।
শেহবাজ শরিফের আমন্ত্রণ
বৈঠকে শেহবাজ শরিফ ড. ইউনূসকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এ সফর দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন
- জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান
- মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া
- এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে বহুবার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী সময়ে দলীয় দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশ্লেষকদের মতে, “জুলাই সনদ” হতে পারে সেই শূন্যস্থান পূরণের একটি বড় সুযোগ।
নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, জুলাই সনদ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, “বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার। জুলাই সনদ দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলে সেটি দেশের ইতিহাসে মাইলফলক হবে।”
বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা ‘জুলাই সনদ’ শুধু একটি দলিল নয়, বরং ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি আন্তরিকভাবে এটি গ্রহণ করে, তাহলে দেশে স্থায়ী শান্তি, সুশাসন ও উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
MAH – 13002 I Signalbd.com