ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা রাশিয়ার তেল ও জ্বালানি শিল্পকে আরও বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে। ১৮তম নিষেধাজ্ঞার এই নতুন প্যাকেজে প্রতি ব্যারেল তেলের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭.৬ ডলার, যা বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের প্রায় ১৫ শতাংশ কম।
রয়টার্সের ব্রাসেলস রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার তেল ব্যবসায় কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা রাশিয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং বিশ্ববাজারে তার অবস্থানের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। গত বছর থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওপর ধারাবাহিকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই ১৮তম ধাপ, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতায় নতুন মোড় নিয়ে এসেছে।
রাশিয়ার তেলবাজারে নতুন মূল্যসীমা: ইইউর শক্ত পদক্ষেপ
ইইউর নতুন নিষেধাজ্ঞায় অপরিশোধিত তেলের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ব্যারেল প্রতি ৪৭.৬ ডলার, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ফিউচার্সের দাম প্রায় ৭০ ডলার প্রতি ব্যারেল। এর মানে রাশিয়াকে কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা দেশটির রাজস্ব আয় কমাবে।
২০২২ সালের ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ইইউ মোট ১৮টি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে, যার একটি বড় অংশই তেল ও গ্যাসের ওপর কেন্দ্রিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসপ বোরেল এবং পরবর্তীতে কাজা কালাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, ‘ইউরোপ রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে কঠোর এবং ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, যা মস্কোকে তার আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য করবে।’
রুশ প্রতিক্রিয়া ও বাজার বিশ্লেষণ
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এই নিষেধাজ্ঞাকে একপক্ষীয় এবং অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। এ ধরণের পদক্ষেপ আমাদের অর্থনীতিকে তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।’ তিনি আরও যোগ করেছেন, ‘নতুন প্যাকেজের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে, কিন্তু যাঁরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তাঁরা নিজেও ক্ষতির মুখে পড়বেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তবে নতুন মূল্যসীমার কারণে রাশিয়ার তেলের রপ্তানি কমে যেতে পারে এবং আয়ের বড় অংশ হারাতে হবে। এর ফলে দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামরিক সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইইউর নতুন নিষেধাজ্ঞাকে ‘সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়’ বলে অভিহিত করেছেন। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রিই সিবিহা বলেন, ‘রাশিয়ার তেল থেকে আসা অর্থের প্রবাহ বন্ধ করা হলে, দেশটির আগ্রাসন বন্ধ করতে সহায়তা পাওয়া যাবে।’
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যও রাশিয়ার জ্বালানির মূল্যসীমা আরও কমিয়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনার পক্ষে না থাকার কারণে ইইউর পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে।
শান্তি আলোচনা ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের মাঝেই শান্তি আলোচনায় গতি আনার তাগিদ দিয়েছেন জেলেনস্কি। চলতি বছরের শুরুতে তুরস্কে দু’দফা আলোচনায় বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষত বন্দী বিনিময় ও নিহত সৈন্যদের মরদেহ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে। তবে সাম্প্রতিক রুশ বিমান হামলায় উত্তেজনা আবার বাড়ছে, যার কারণে শান্তি আলোচনা স্থবির।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়াকে ৫০ দিনের মধ্যে শান্তি চুক্তি করার জন্য হুমকি দিয়েছেন, অন্যথায় আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু রাজনৈতিক কূটকৌশল হিসেবেই দেখা উচিত।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ: রাশিয়ার তেল শিল্পে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ও ভবিষ্যত
রাশিয়ার তেলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
রাশিয়ার অর্থনীতির এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তেল ও গ্যাস রপ্তানি। দেশের রপ্তানি আয় এবং সরকারি বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস থেকে। তাই তেল বিক্রির মূল্যসীমা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা মানে সরাসরি রাশিয়ার অর্থনীতিকে আঘাত দেওয়া।
বিশ্ববাজারে মূল্যসীমা আরোপের প্রভাব
মূল্যসীমা আরোপের ফলে রাশিয়ার তেল বিক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম মূল্য পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক ক্রেতাই বেশি দাম দিয়ে অন্য উৎস থেকে তেল কিনতে শুরু করেছে, যার ফলে রাশিয়ার বাজার অংশ কমছে। এর ফলে রাশিয়ার আয়ের বড় অংশ সংকুচিত হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রতিরোধ ও বিকল্প পরিকল্পনা
রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার মোকাবেলায় তার বিকল্প বাজার খুঁজে বের করছে, যেমন চীন, ভারত ও অন্যান্য এশীয় দেশ। এছাড়াও রাশিয়া ভিন্ন প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ এবং সীমাবদ্ধ বাজারের কারণে এটি দীর্ঘমেয়াদে কঠিন হবে।
ইইউ ও পশ্চিমা দেশগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপ
ইউরোপ এবং জি-৭ দেশগুলো রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন আর্থিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তেলের মূল্যসীমা নিয়ে আরও সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চলছে, যাতে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ানো যায়।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার তেল-জ্বালানি শিল্পে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রতি ব্যারেল তেলের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে রাশিয়ার আয় সীমিত করার মাধ্যমে ইউরোপ রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন থামাতে চাইছে। যদিও রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তবে আন্তর্জাতিক চাপ এবং বাজারের পরিবর্তন দেশটির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সংকটের মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের শান্তি আলোচনায় গতি আনার প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে, যেখানে বিশ্বশক্তিরাও সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটিলতা ও অর্থনৈতিক লড়াই বিশ্ববাজার এবং ভূ-রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।



