বিশ্ব

গাজায় ইসরায়েলি হামলা, স্বাস্থ্য সংকট ও মানবিক বিপর্যয়

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলা ও জ্বালানিসংকটের কারণে সৃষ্ট মানবিক দুর্দশা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। সামরিক সংঘাতের উত্তাপে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এবং চিকিৎসকরা আহতদের চিকিৎসায়_prioritize_ করতে পারছেন না। প্রতিদিন হাজারো মানুষ আহত হচ্ছেন, যেখানে কারও কারও প্রাণ সংকটে।

গত ১৮ জুলাই ভোরে গাজার বিভিন্ন অংশে ইসরায়েলি বিমান ও স্থল বাহিনী চালানো হামলায় অন্তত ৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু, বৃদ্ধ ও নারী। তুফফা, জাবালিয়া আন-নাজলা এবং আল-মাওয়াসি এলাকায় নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষত খাদ্য ও পানীয় সরবরাহের জন্য হন্যে হয়ে রাস্তায় নেমে পড়া গরিব ও অসহায়দের ওপর হামলার ফলে নিহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক।

আহতদের অবস্থা ও চিকিৎসা সংকট:

আল-জাজিরার ফিলিস্তিন সংবাদদাতা হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, হামলার সময় আহতদের মধ্যে অনেক শিশু ও নারী রয়েছেন। আহতদের নাসের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে তাদের শরীরে ড্রোন হামলার চিহ্ন পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, জ্বালানি সংকটের কারণে হাসপাতালের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় বন্ধ, যা জীবন রক্ষার জন্য এক বড় বাধা। চিকিৎসকরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, কার আগে চিকিৎসা দেবেন তা নির্ধারণে তারা ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন।

আল-শিফা হাসপাতালের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান জিয়াদ আবু হুমায়দান জানিয়েছেন, হাসপাতালের মাত্র কয়েকটি বিভাগ চালু আছে, বাকিগুলো বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ।

ডায়ালাইসিস রোগী ওমদা দাগমাশ বলছেন, “আগে সপ্তাহে তিনবার চার ঘণ্টা করে ডায়ালাইসিস করতাম, এখন খাবার পাওয়ার অভাবে, হাসপাতাল পৌঁছানোও কঠিন। ডায়ালাইসিসের সেশন ও সময় কমিয়ে আনা হয়েছে, যা আমার মতো রোগীদের জন্য জীবন-মৃত্যুর বিষয়।”

জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎ বিপর্যয়:

গাজায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বাধাগ্রস্ত। হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ না থাকায় জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে রোগীদের চিকিৎসা প্রক্রিয়া অর্ধেক হয়ে পড়েছে।

জ্বালানির অভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় হাসপাতালের পরিবেশও অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যা বিশেষত শিশু ও প্রবীণদের জন্য প্রাণহানিকারক।

গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা:

বাস্তবতা হচ্ছে, গাজার সাধারণ মানুষ প্রতিদিন বোমার আঘাতের ভয়ে ঘুম হারাম। খাবার, পানি ও চিকিৎসা সরবরাহের সংকটে তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার। অনেকেই শিশু ও বৃদ্ধদের সঙ্গে ঘরছাড়া হয়ে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমে পড়েছে।

তবে খাদ্যসহায়তা ও মানবিক সাহায্যের জন্য গাজার রাস্তায় বের হওয়া মানুষের উপর হামলা চালানোর ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে, যেখানে অনেকেই নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া ও জনমত:

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মাআরিভ পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ৪৪ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক মনে করেন, গাজায় চলমান হামলা তাদের দেশের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে। অর্থাৎ ইসরায়েলিদের মধ্যেও এই যুদ্ধে সমর্থন কমে আসছে।

গত বৃহস্পতিবার গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি বোমা হামলা চালিয়ে ৩ জন নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের প্রতি কঠোর সমালোচনা বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক সাহায্যের জোর দাবি:

বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও রাষ্ট্রগুলি গাজার পরিস্থিতির প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘসহ অনেক প্রতিষ্ঠান গাজার অবরোধ ত্বরান্বিত করে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে, যদি অবরোধ অব্যাহত থাকে তবে এটি একটি বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে। তারা অবিলম্বে চিকিৎসা ও জরুরি পরিষেবার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

গাজা সংকটের পেছনের জটিল কারণ:

গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৭ সালের পর থেকে ইসরায়েলি অবরোধ ও সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে, যা এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসবাদ, রাজনীতি, এবং আন্তর্জাতিক চাপের মধ্য দিয়ে গাজার অবরুদ্ধ জনপদ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বোমা হামলা ও খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

মানবিক সংকটের সমাধানে করণীয়:

১. অবরোধ অবিলম্বে প্রত্যাহার করে জ্বালানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী গাজায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।

২. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত মানবিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

৩. ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘর্ষ সমাধানে শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা জরুরি।

৪. গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান।

গাজার মানুষের জীবন নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ও অবরোধ পরিস্থিতিকে এক গভীর মানবিক সংকটে নিয়ে এসেছে। আজ এখানকার হাসপাতালগুলো বিদ্যুৎ ও চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই বিপন্ন। বিশ্ববাসীকে এখনই সচেতন হয়ে, মানবিক সাহায্য পাঠিয়ে গাজার প্রাণ বাঁচানোর কাজ করতে হবে।

গাজায় চলমান সংঘাত দ্রুত বন্ধ না হলে, এটি আরও বড় আন্তর্জাতিক সংকটে পরিণত হবে, যা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button