ব্রিকস সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা। পাল্টা জবাবে ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন অতিরিক্ত ১০% শুল্ক বসানোর হুমকি—ব্রিকসের নীতির সঙ্গে যারা একমত হবে, ছাড় পাবে না কেউ।
ব্রিকস সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও ইরানে হামলার কড়া সমালোচনা
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিকসের বার্ষিক সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। একইসঙ্গে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা শুল্ক নীতিকেও আক্রমণাত্মক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ব্রিকস সদস্যরা।
ব্রিকসের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “একতরফাভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে।”
ট্রাম্পের পাল্টা হুঁশিয়ারি: ১০% শুল্ক বসবে ব্রিকস-সমর্থকদের ওপর
এই সমালোচনার জবাবে ট্রাম্প রোববার রাতে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লিখেছেন, “যেকোনো দেশ, যারা ব্রিকসের আমেরিকাবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করবে, তাদের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হবে। ব্যতিক্রম কিছুই হবে না।”
ট্রাম্প আরও বলেন, “আমরা এমন কোনো সহযোগিতা সহ্য করব না, যা আমাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে।”
এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প আবারও তার আগ্রাসী বাণিজ্যনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেন, যা এর আগেও মার্কিন-বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছিল।
ইরানে হামলা ও ব্রিকসের প্রতিক্রিয়া
ব্রিকস নেতারা সম্মেলনে ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত আক্রমণ ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়, যার কড়া সমালোচনা করে ব্রিকস দেশগুলো। তারা একে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলেও আখ্যা দেয়।
ব্রিকসের এমন প্রতিক্রিয়া স্পষ্টতই মার্কিন আধিপত্যবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত অবস্থান।
নতুন সদস্য, পুরনো মতানৈক্য
ব্রিকস বর্তমানে ১১ সদস্যের একটি বড় জোট। পুরনো সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়া। তবে নতুন সদস্যদের যোগদানে মতভিন্নতা বেড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ নিয়ে ব্রিকস দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে কথা বললেও ইরান প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিলুপ্তির কথা বলে থাকে, যা এই জোটে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে।
সম্মেলনে দুই প্রধান নেতার অনুপস্থিতি
এবারের সম্মেলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা কমে যায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি অনুপস্থিতির কারণে। পুতিন সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যোগ দেন, কারণ তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
চীনের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং অংশ নেন। বিশ্লেষকদের মতে, এ অনুপস্থিতি ব্রিকসের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং ঐক্যে প্রশ্ন তুলে দেয়।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও আগের হুমকি
ট্রাম্প আগেও ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোকে শাস্তিমূলক শুল্কের হুমকি দিয়েছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে তিনি বলেছিলেন, যারা মার্কিন ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালুর চেষ্টা করবে, তাদের ওপর ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হতে পারে।
এমনকি ১ আগস্টের মধ্যে কোনো চুক্তি না হলে একতরফাভাবে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেনসেন্টও নিশ্চিত করেছেন, এই শুল্ক কার্যকর হবে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী।
এআই এবং অর্থনীতিতে ব্রিকসের বার্তা
ব্রিকস নেতারা সম্মেলনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহারে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। তারা বলেন, “AI যেন শুধুমাত্র ধনী দেশগুলোর হাতে না থাকে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।”
এছাড়া, তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-কে কেন্দ্র করে বৈষম্যহীন ও স্বচ্ছ বহুপক্ষীয় বাণিজ্য কাঠামোর প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতি?
বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিকসের ইরানপ্রীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান স্পষ্টতই এক নতুন বৈশ্বিক বিভাজনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে বিশ্বের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে কি না—সে প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আর এই হুমকির মাধ্যমে তিনি তার নির্বাচনী বার্তা আরও জোরদার করলেন।
সারসংক্ষেপ
ব্রিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র—এই সংঘর্ষ এখন শুধু রাজনৈতিক নয়, সরাসরি অর্থনৈতিক। ইরানে হামলা এবং নতুন শুল্ক হুমকি দুই-ই প্রমাণ করে যে, ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি হবে দুই মেরুকেন্দ্রিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দেশ কোন দিকে দাঁড়াবে?
এম আর এম – ০২১৭, Signalbd.com



