ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার মনোনয়নের পিছনে কি সত্যি রয়েছে?
গত ৭ জুলাই ২০২৫, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি চিঠির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন। এই চিঠিটি অনলাইনে প্রকাশ করে তিনি ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন, ‘ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অঙ্গীকার প্রদর্শন করেছেন।’
নোবেল শান্তি পুরস্কার মানবতার জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখায় দেওয়া হয়। ১৯০১ সাল থেকে ছয়টি বিভাগে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, যার একটি হল শান্তি পুরস্কার। বিশ্বে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মাননার এই পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার নিয়ম এবং বিজয়ীর নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ কঠোর ও সূক্ষ্ম।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের নিয়ম ও প্রক্রিয়া
নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন যেকেউ দিতে পারেন না। শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তিরাই মনোনয়ন দেয়ার অধিকার রাখে, যেমন:
- সরকার প্রধান ও সরকার সদস্যরা
- পার্লামেন্ট সদস্যরা
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, আইন ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপকগণ
- আগের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তরা
- আন্তর্জাতিক বিচারকদের সদস্যরা ইত্যাদি
নিজে নিজে মনোনয়ন দেয়া যায় না। মনোনয়ন প্রক্রিয়া প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে বন্ধ হয়ে যায়, আর অক্টোবর মাসে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। ৫০ বছর পর্যন্ত মনোনীতদের নাম গোপন রাখা হয়।
ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টা: বিতর্ক ও সমালোচনা
ট্রাম্প এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। এছাড়া, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব কমানোর মধ্যস্থতাও তিনি করেছেন। গত মে মাসে দুই দেশের মধ্যে চার দিনের যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতি স্থাপিত হয়, যার জন্য ট্রাম্প নিজেকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানও আগেই ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
তবে ট্রাম্পের মনোনয়ন নিয়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড এক্স (সাবেক টুইটার) এ লিখেছেন, ‘নেতানিয়াহু প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পকে তোষামোদ করছেন।’ অনেকেই মনে করেন, নেতানিয়াহু রাজনৈতিক সুবিধা নিতে এই মনোনয়ন দিয়েছেন। আবার অনেকেই ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয় বলেও মত দেন।
নোবেল কমিটির বক্তব্য ও পুরস্কারের ইতিহাস
নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান জোরগেন ওয়াটনে ফ্রাইডনেস বলেছেন, ‘বাস্তবে যে কেউ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। এর ইতিহাসে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ পুরস্কার পেয়ে থাকেন।’ তবে এ পুরস্কারের পিছনে একটি রাজনৈতিক বার্তাও থাকে।
ইতিহাসে অনেক বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিও এই পুরস্কার পেয়েছেন, তবে তারা আন্তর্জাতিক ও জাতিগত সংঘাত সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক চারজন প্রেসিডেন্ট—থিওডোর রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন, জিমি কার্টার ও বারাক ওবামা—এ পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এই পুরস্কার নিয়ে তাঁদের ক্ষেত্রেও বিতর্ক ছিল। বিশেষ করে ওবামা মাত্র ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই এই পুরস্কার পান।
এবারের মনোনয়ন এবং সময়সীমা
এ বছর নরওয়ের নোবেল কমিটির কাছে ৩৩৮ টি মনোনয়ন এসেছে, যার মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি ও ৯৪টি প্রতিষ্ঠান। কমিটি প্রথমে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে, তারপর বিশেষজ্ঞরা মূল্যায়ন করেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সাধারণত ঘোষণার কিছুদিন আগে নেওয়া হয়।
তবে বিষয়টি জটিল: নেতানিয়াহু যে মনোনয়ন দিয়েছেন, তা এ বছরের জন্য সম্ভবত বিবেচনায় নেওয়া হবে না, কারণ মনোনয়ন প্রক্রিয়া গত জানুয়ারি মাসে শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ট্রাম্পের এই মনোনয়ন হয়তো আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে।
রাষ্ট্র প্রধানের মনোনয়নের গুরুত্ব ও বিতর্ক
একজন রাষ্ট্র প্রধানের মনোনয়ন কি বিশেষ গুরুত্ব পায়? নোবেল ফাউন্ডেশনের নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা মনোনয়ন দেন, তাঁরা সবাই সমান। তাই রাষ্ট্র প্রধান, সংসদ সদস্য কিংবা অধ্যাপক—সবার মনোনয়নই সমান গুরুত্ব পায়।
তবে রাজনৈতিক প্রভাব এবং মনোনয়নের পেছনে নানা রাজনৈতিক স্বার্থ থাকার আশঙ্কা থেকে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে নেতানিয়াহুর মত রাজনৈতিক নেতা যখন ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেন, তখন তা রাজনৈতিক তোষামোদ হিসেবেই দেখা হয়।
ট্রাম্প শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবেন কি?
ট্রাম্পের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। একদিকে তার শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা আছে, অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিতর্ক তাকে ঘিরে রয়েছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে দেখা গেছে, শুধুমাত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বার্তাও অনেক সময় প্রাধান্য পায়। ফলে, ট্রাম্প যদি এই পুরস্কার পান, তবে সেটা কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবেও দেখা হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান থাকা সত্ত্বেও, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম, সময়সীমা ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নেতানিয়াহুর মনোনয়ন ট্রাম্পকে প্রাধান্য দেওয়ার একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ হলেও, আসল বিজয়ী কে হবে তা আগামী অক্টোবর মাসে জানা যাবে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু এক ব্যক্তির সম্মান নয়, এটি বিশ্বে শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার প্রতীক। তাই মনোনয়ন ও বিজয়ীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণই পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।



