
আফগানিস্তানের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং ইমারাতে ইসলামিয়ার মুখপাত্র মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ সম্প্রতি জাতিসংঘের ওপর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “জাতিসংঘ আজ কোনো নিরপেক্ষ বা স্বাধীন সংস্থা নয়; এটি পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাবাধীন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব শান্তি রক্ষা, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কিন্তু মাওলানা জাবিহুল্লাহ মনে করেন, বাস্তবে এ প্রতিষ্ঠান এখন পশ্চিমা রাজনৈতিক এজেন্ডার অনুগত হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, “জাতিসংঘের কার্যক্রম ও নীতিমালা বর্তমানে একেবারেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটি আদর্শ এবং বাস্তবতার মধ্যে বড় ব্যবধান তৈরি করেছে।”
আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিতর্ক
মাওলানা জাবিহুল্লাহ বিশেষ করে জাতিসংঘে আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “বর্তমানে জাতিসংঘে যে ব্যক্তি আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তিনি আসলে আফগান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন কিনা, তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন থেকে গেছে। তার কোন বৈধতা নেই এবং তিনি আফগান জনগণের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি নন।”
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার পর থেকে, ইমারাতে ইসলামিয়া বারবার জাতিসংঘের কাছে তাদের মনোনীত প্রতিনিধিকে আফগানিস্তানের আসনে বসানোর দাবি জানিয়ে আসছে। তবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্বীকৃতি বিষয়ক কমিটি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এবং বারবার এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে।
ফলে, জাতিসংঘে আফগানিস্তানের আসনে বর্তমানে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা মূলত ২০২১ সালের আগের পশ্চিমা-সমর্থিত আশরাফ গনী সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা। বর্তমানে তারা অন্তর্বর্তী দূতের দায়িত্ব পালন করছেন।
পশ্চিমা দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবন্ধকতা
ইমারাতে ইসলামিয়ার প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বাধা সৃষ্টি করছে। তাদের অভিযোগ, আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনে নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং দেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভাব রয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করছে, “যদি আফগানিস্তানের সরকার নারী অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের স্বীকৃতি দিতে পারে না।” যদিও এই দাবি নিয়ে তালেবান সরকার এবং তাদের সমর্থকরা পুরোপুরি একমত নন।
রাশিয়ার একতরফা স্বীকৃতি
তবে চলতি জুলাই মাসের শুরুতেই রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইমারাতে ইসলামিয়াকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি ইমারাতে ইসলামিয়ার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাদের অবস্থান মজবুত করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন দিক নির্দেশ করছে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবের বাইরে অন্য শক্তিগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে।
জাতিসংঘের ভবিষ্যত ও বিশ্বরাজনীতি
বিশ্ব রাজনীতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে বহুকাল ধরেই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের মতো সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক তীব্র হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব কমাতে এবং সত্যিকার অর্থে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের সংস্কার প্রয়োজন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
তবে, বর্তমানে যেভাবে জাতিসংঘ পরিচালিত হচ্ছে, তাতে স্বতন্ত্র এবং অবাধ মতপ্রকাশের জায়গা কমে আসছে। এই অবস্থায়, আফগানিস্তানের মতো সংকটপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি কার্যকর সমাধান বের করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ইমারাতে ইসলামিয়া জাতিসংঘের প্রক্রিয়ার প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করেছে, তথাপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশা করছে, ভবিষ্যতে জাতিসংঘ সংস্থাটি আরো স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়ে উঠবে।
আফগানিস্তানে চলমান সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক সংঘাত মোকাবিলায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন ও সহায়তা কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিলেমিশে কাজ করলে আফগান জনগণের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
ইমারাতে ইসলামিয়ার দাবি ও জাতিসংঘের অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা।
তবে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ কেমন হবে, তা নিয়ে নানা দ্বিধা ও মতানৈক্য বিদ্যমান। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সকল পক্ষের সাথে সংলাপ স্থাপন করাই হলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মূল কৌশল।
সংক্ষেপে:
- মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ জাতিসংঘকে নিরপেক্ষ নয়, পশ্চিমা এজেন্ডার অধীনে পরিচালিত বললেন।
- আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে জাতিসংঘে তীব্র বিতর্ক চলছে।
- ইমারাতে ইসলামিয়া বারবার তাদের প্রতিনিধিকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
- পশ্চিমা দেশ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
- রাশিয়া একতরফা স্বীকৃতি দিয়েছে ইমারাতে ইসলামিয়াকে।
- জাতিসংঘের ভবিষ্যত ও আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ও প্রত্যাশা রয়েছে।
MAH – 12067, Signalbd.com