স্কুলে হিন্দি বাধ্যতামূলক নয়, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার

মহারাষ্ট্র সরকার স্কুলগুলোতে হিন্দি ভাষার বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের নির্দেশিকা প্রত্যাহার করেছে। রাজ্যজুড়ে বিরোধ ও প্রতিবাদের জোরালো চাপের মুখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ৩০ জুন, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশ এক সরকারি বৈঠকের পর এ কথা জানান।
গত ১৬ এপ্রিল, রাজ্য মন্ত্রিসভার তরফে স্কুলের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দি বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিবসেনা ও এনসিপি সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্দেশের কঠোর বিরোধিতা করে। অবশেষে, সরকার এই নির্দেশ প্রত্যাহার করে।
মুখ্যমন্ত্রী ফাডনবিশের ঘোষণা: বিশেষ কমিটি গঠন
মুখ্যমন্ত্রী ফাডনবিশ জানিয়েছেন, রাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নরেন্দ্র যাদবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও ভাষা শিক্ষার প্রয়োগ নিয়ে সুপারিশ দেবে। কমিটির রিপোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকারে জমা দেওয়া হবে। এরপর সেই সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
কেন্দ্রীয় নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ও হিন্দি বাধ্যতামূলক শিক্ষা
২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy-NEP) ঘোষণা করে। ওই নীতিতে বলা হয়েছিল, সমস্ত রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও হিন্দি শেখানো বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এই নীতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও বিরোধিতা দেখা দেয় বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে। তাদের ধারণা, হিন্দি ভাষাকে জোরপূর্বক বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে যা দক্ষিণ ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর একটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে।
তামিলনাড়ুর আন্দোলন: হিন্দি বিরোধিতার প্রতীক
দক্ষিণের সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী রাজ্য তামিলনাড়ু এই নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন বারবার জানিয়েছেন, রাজ্যে হিন্দি বাধ্যতামূলক করার নীতির কারণে রাজ্য সরকারের জন্য নির্ধারিত সরকারি অনুদান আটকে রাখা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, হিন্দি বাধ্যতামূলক না করার কারণে রাজ্যের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না।
স্ট্যালিন তামিলনাড়ুর পাশাপাশি দক্ষিণের অন্য রাজ্যগুলো—কেরালা, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানাকেও জনমত গঠন করে এই নীতির বিরোধিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যদিও অন্ধ্রপ্রদেশের সরকার কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিকে তুলনামূলকভাবে গ্রহণ করেছে।
মহারাষ্ট্রেও হিন্দি শিক্ষার প্রতিবাদ
মহারাষ্ট্রেও মারাঠি ভাষার প্রাধান্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে হিন্দি বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিরোধিতা দেখা যায়। রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো—শিবসেনা, এনসিপি ও কংগ্রেস—মিলে এই নীতির প্রতিবাদ করে। তারা মনে করে, মারাঠি ভাষাকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা হচ্ছে এবং হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হলে এটি মারাঠি ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বড় হুমকি।
বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, হিন্দি বাধ্যতামূলক শিক্ষার নির্দেশিকা তাদের রাজ্যের ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে হেনস্তা করবে। এই কারণে তারা বিভিন্ন স্তরে আন্দোলন শুরু করে। মহারাষ্ট্রের শিক্ষাবিদরাও একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং স্থানীয় ভাষার গুরুত্বে জোর দেন।
ভাষা ও শিক্ষা: ভারতে ভাষাগত সংবেদনশীলতার গুরুত্ব
ভারতের মতো বহুভাষিক দেশে ভাষার সংবেদনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাজ্যের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা হবে। কোনো এক ভাষাকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
মহারাষ্ট্রের রাজ্য শিক্ষানীতি অনুযায়ী, স্কুলে মারাঠি ও ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। হিন্দি শেখানোর বিষয়ে সরকার এখন আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। কারণ শিক্ষার্থীদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা: কমিটির সুপারিশ ও নতুন শিক্ষা নীতি
নরেন্দ্র যাদবের নেতৃত্বাধীন কমিটি আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকারে একটি রিপোর্ট দেবে। এই রিপোর্টে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি, ভাষা শিক্ষার প্রয়োগ এবং স্থানীয় ভাষার সংরক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত সুপারিশ থাকবে।
কমিটির সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে মহারাষ্ট্র সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। এতে ভাষাগত বিরোধ নিষ্পত্তি হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হবে বলে আশাবাদ করা হচ্ছে।
সংক্ষেপে
- মহারাষ্ট্র সরকার স্কুলে হিন্দি বাধ্যতামূলক শিক্ষার নির্দেশিকা প্রত্যাহার করেছে।
- বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের চাপের মুখে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
- শিক্ষাবিদদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে।
- নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন নিয়ে তিন মাসের মধ্যে কমিটি সুপারিশ দেবে।
- তামিলনাড়ু ও দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের হিন্দি বিরোধী আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে মহারাষ্ট্রে।
- মারাঠি ও ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে।
- কোনো ভাষাই রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না—এই নীতি বজায় থাকবে।