বিশ্ব

রাশিয়ার পোক্রভস্ক দখলে ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর পোক্রভস্ক দখলে রাশিয়া প্রায় এক লাখ দশ হাজার সেনাকে মোতায়েন করেছে। শুক্রবার (২৯ জুন) ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ওলেক্সান্দর সিরস্কি এই তথ্য জানিয়েছেন। পোক্রভস্ক দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান রণক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

পোক্রভস্ক: কৌশলগত হটস্পট

পোক্রভস্কের অবস্থান এবং কৌশলগত গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। এই শহরটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় প্রধান বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সিরস্কি জানান, ফ্রন্টলাইনের প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশে পোক্রভস্কই সবচেয়ে উত্তপ্ত এবং সংঘর্ষপ্রবণ এলাকা। গত একবছর ধরে রাশিয়ার সেনারা এই শহরটি দখল করতে একের পর এক শক্তিশালী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনও তারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জনে ব্যর্থ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই এলাকায় নিজের সেনাবাহিনী ও অস্ত্রের সম্পদ নিয়ে ব্যয় করছে প্রচুর, তবুও পোক্রভস্ক দখলে তারা সফল হয়নি। ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে শক্তভাবে, যা রুশ সেনাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিকূলতা তৈরি করেছে।

অন্যান্য সামরিক সংঘর্ষ ও রাশিয়ার ক্ষতি

পোক্রভস্ক ছাড়াও অন্যান্য ফ্রন্টে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্টা হামলা অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ওডেসা-তে রাশিয়ার ড্রোন হামলায় অন্তত দুইজন প্রাণ হারিয়েছেন। এই আক্রমণে শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার অধিকৃত ক্রাইমিয়া অঞ্চলেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত। কিয়েভের সামরিক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে তিনটি রুশ হেলিকপটার ধ্বংস হয়েছে। এটি রুশ সেনাবাহিনীর জন্য বড় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দখলে ইউক্রেনের অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

পুতিনের দখল চেষ্টার পেছনের কৌশল

পুতিনের রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করেছে। এই যুদ্ধে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলি দখল করাই মূল লক্ষ্য। পোক্রভস্ক শহরটি ডনবাস অঞ্চলের অংশ হওয়ায়, এটি দখল করলে রাশিয়ার জন্য পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে।

তবে ইউক্রেনীয় বাহিনী ও পশ্চিমা সমর্থন পেয়ে পুতিনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো নিয়মিত ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে, যার ফলে ইউক্রেনের প্রতিরোধ শক্তিশালী হচ্ছে। এতে করে রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হচ্ছে ইউক্রেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধের ভবিষ্যৎ

বিশ্ববাসী এই সংঘর্ষকে এক বিরাট নিরাপত্তা ও মানবিক সংকট হিসেবে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোট ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে সংঘর্ষের স্থায়িত্ব এবং রাশিয়ার আক্রমণ কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোক্রভস্কের মতো কৌশলগত এলাকাগুলো রাশিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এই শহরটি দখল করতে সক্ষম হয়, তাহলে রাশিয়ার সামরিক সুবিধা অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, ইউক্রেন যদি শহরটি রক্ষা করতে পারে, তবে যুদ্ধের গতি পাল্টে যেতে পারে।

পোক্রভস্ক দখলের জন্য রাশিয়ার পরিকল্পনা ও সামরিক সক্ষমতা

রাশিয়ার সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও উচ্চমানের প্রযুক্তি নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। গত একবছরে তারা প্রচুর ট্যাঙ্ক, ড্রোন, রকেট লঞ্চার ও রকেট ব্যবহারে দক্ষতা দেখিয়েছে। এছাড়াও, রাশিয়ার ‘ওল্ডস্কুল’ পদ্ধতিতে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে যেখানে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে অঞ্চল দখলের চেষ্টা চলছে।

তবে ইউক্রেনের গঠনমূলক প্রতিরক্ষা কৌশল, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সাহায্য রাশিয়ার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করেছে। পোক্রভস্কের মতো এলাকাগুলোতে গ্রামে গ্রামে, শহর শহরে লড়াই চলছেই। বিশেষ করে শীতের আগমনী বার্তায় দুই পক্ষই শক্তি জমাচ্ছে।

মানবিক পরিস্থিতি ও স্থানান্তর

যুদ্ধের তীব্রতায় পোক্রভস্কসহ আশেপাশের এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পানি সরবরাহ বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন এই সংকট মোকাবেলায় কাজ করছে।

সংক্ষিপ্ত তথ্য ও পর্যালোচনা

  • রাশিয়ার পোক্রভস্ক দখলের জন্য সেনা সংখ্যা: প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার
  • ফ্রন্টলাইনের দৈর্ঘ্য: ১,২০০ কিলোমিটার
  • ওডেসায় ড্রোন হামলায় প্রাণহানি: ২ জন
  • ক্রাইমিয়াতে হামলায় ধ্বংস হওয়া হেলিকপটার: ৩টি
  • ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর প্রধান: ওলেক্সান্দর সিরস্কি
  • রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য: পোক্রভস্ক এবং ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ

পোক্রভস্কের মতো কৌশলগত শহর দখল করার জন্য রাশিয়া যে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু ইউক্রেনের দৃঢ় প্রতিরোধ ও পশ্চিমা সমর্থনের কারণে যুদ্ধ চলতে চলতে আরও জটিল ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এই সংঘর্ষের ভবিষ্যত ও শেষ কবে হবে, তা এখনো নির্ধারিত নয়। তবে নিঃসন্দেহে, পোক্রভস্ক ইউক্রেন যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button