বিশ্ব

ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই : যুক্তরাষ্ট্র

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক ইস্যু। গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনার উপর হামলা চালায়, যেখানে ব্যবহার করা হয় ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাংকার-বাস্টার’ বোমা। তবে ইরান ইউরেনিয়ামের কোনো অংশ সরিয়ে নিয়েছে কিনা—এই বিতর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের কাছে কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই যা নিশ্চিত করে ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়েছে।

ইরানের ইউরেনিয়াম সরানোর কোনো প্রমাণ নেই — পেন্টাগনের দাবি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বৃহস্পতিবার পেন্টাগনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমি এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য দেখিনি বা জানি না, যা বলছে যে ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কোনো অংশ সরিয়ে নিয়েছে বা গোপন কোনো স্থানে নিয়ে গেছে।” তিনি আরও জানান, হামলার পর ফলাফল পর্যবেক্ষণ চলছে, যাতে বোঝা যায় এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছে।

হেগসেথের বক্তব্যের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একমত হয়েছেন। ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লেখ করেন, ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় যে যানবাহনগুলো দেখা গেছে, সেগুলো মূলত কংক্রিট শ্রমিকদের ছিল যারা টানেলের মুখ বন্ধ করার কাজ করছিল। ট্রাম্পের দাবি, কোনো ইউরেনিয়াম সরানো হয়নি।

বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দাদের মতামত: ইরান হয়তো আগে থেকেই ইউরেনিয়াম সরিয়ে রেখেছিল

তবে একাধিক বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য বলছে, ইরান সম্ভবত হামলার আগেই ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনাটি থেকে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ সরিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম গোপন স্থানে সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের পরমাণু পরিদর্শকদের অজানা।

ম্যাক্সার টেকনোলজিসের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফোর্দো স্থাপনার প্রবেশ পথে অস্বাভাবিক যানবাহনের উপস্থিতি ছিল। এটি ইঙ্গিত দেয়, ইরান হয়তো দ্রুত ইউরেনিয়াম সরিয়ে গোপন করেছে।

এক জ্যেষ্ঠ ইরানি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, হামলার আগে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

ইউরেনিয়ামের মজুত অক্ষত: ফাইনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনের সারাংশ

ফাইনান্সিয়াল টাইমস ইউরোপীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত মূলত অক্ষত রয়েছে, কারণ তা শুধুমাত্র ফোর্দোতে সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্য স্থাপনাগুলোতেও এর মজুত ছিল, যা হামলার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি: হামলা ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘সফল’

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমাদের হামলার সফলতা খাটো করার চেষ্টা চলছে, তবে প্রাথমিক গোয়েন্দা মূল্যায়নে দেখা গেছে, হামলা ইরানকে কয়েক মাসের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, সিআইএ পরিচালক জন র‍্যাটক্লিফের মতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পুনর্গঠন করতে ইরানকে বছর কয়েক সময় লাগবে।

সেনেটের গোপন ব্রিফিং: হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সদস্যদের জন্য বৃহস্পতিবার একটি গোপন ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নেতারা হামলার বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর কৌশল, গোয়েন্দা তথ্য ও হামলার ফলাফল আলোচনা হয়।

ইরানের হুঁশিয়ারি: যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হামলার পর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার কোনো হামলা চালায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো ইরানের পাল্টা আঘাতের লক্ষ্য হবে।” এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

  • ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম: ইরান দাবি করে পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।
  • যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কয়েক মাসের জন্য স্থগিত করতে সক্ষম হলেও, সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
  • আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের প্রতি শান্তি ও কূটনীতির আহ্বান জানিয়ে আসছে।
  • মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা: সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন, যা বিশ্ব বাণিজ্য ও তেলের সরবরাহকেও প্রভাবিত করতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে ইউরেনিয়াম সরানো হয়নি, বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন হামলার আগে ইরান গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক উপাদান গোপন করেছে। ভবিষ্যতে পারমাণবিক ইস্যুতে কূটনৈতিক চাপ ও সামরিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button