
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনিরুল ইসলামের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
মামলার বিস্তারিত ও অভিযোগ
২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী মো. আবুল কালাম আজাদ নামের এক গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, আসামিরা যোগসাজশে ইভ্যালি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী, ইভ্যালি ১১টি মোটরসাইকেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৩ লাখ টাকা নেয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ না করে নানা অজুহাতে গ্রাহককে ঘুরিয়েছে। কোম্পানিটি সুপরিকল্পিতভাবে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও অফারের মাধ্যমে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
ইভ্যালি কেলেঙ্কারি
ইভ্যালি ২০১৯ সালে ব্যাপক আলোচনায় আসে। অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ গ্রাহক আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। নগদ টাকার বিপরীতে বড় ধরনের ডিসকাউন্ট ও অপ্রত্যাশিত অফার দিয়ে বাজার দখল করেছিল তারা। তবে ধীরে ধীরে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এবং অভিযোগ বাড়তে থাকলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমডি রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমাকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে একাধিক গ্রাহকের মামলায় তারা অভিযুক্ত হন।
আদালতের রায়ের তাৎপর্য
আদালতের এই রায়কে অনেকেই নজিরবিহীন বলছেন। কারণ, ই-কমার্স খাতে বাংলাদেশে এ ধরনের বড় প্রতারণার মামলায় প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এভাবে দণ্ডাদেশ হলো। এতে ভবিষ্যতে এ খাতে নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি আরও জোরালো হলো।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের সুযোগও সৃষ্টি হবে বলে আইনজীবীরা আশা করছেন।
প্রতিক্রিয়া ও ভুক্তভোগীদের অবস্থান
রায়ের পর ভুক্তভোগীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের জীবন-সংসার ধ্বংস করে দেওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতির পূর্ণ প্রতিকার হয়তো সম্ভব নয়, তবে এই রায় তাদের ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে।
একজন ভুক্তভোগী বলেন, “আমি আমার জীবনের সঞ্চয় ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করেছিলাম। পণ্য পাইনি, টাকা ফেরতও পাইনি। আজকের রায়ে মনে হচ্ছে অন্তত ন্যায়বিচার হয়েছে।”
অর্থনীতি ও ই-কমার্স খাতে প্রভাব
ইভ্যালির কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত নিয়ে মানুষের আস্থা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল। অনেক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, হাজার হাজার গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারও তখন কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসেল-শামীমার এই শাস্তি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সতর্কবার্তা। প্রতারণা বা গ্রাহকের অর্থ নিয়ে খেললে আইনের কঠোর শাস্তি অনিবার্য।
বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের মতামত
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রায় কেবল ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচারই দেয়নি, বরং দেশের ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথও সুগম করেছে। কারণ, এখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি আরও বাড়বে।
একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “এই রায় দেখিয়ে দিলো, বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে পার পাওয়া যাবে না। এটা ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রথম ধাপ।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
যদিও রায়ে আসামিরা দণ্ডিত হয়েছেন, তবে এখনও হাজার হাজার গ্রাহকের অর্থ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত রয়ে গেছে। অনেক ভুক্তভোগী আশাবাদী যে, সরকারের বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে অন্তত আংশিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ই-কমার্স খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং গ্রাহক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় এ খাত আবারও সংকটে পড়তে পারে।
ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা রাসেল ও শামীমার তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বাংলাদেশের ই-কমার্স ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থাকবে। এটি যেমন ভুক্তভোগীদের আংশিক স্বস্তি দিয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে প্রতারণা রোধে আইনের প্রয়োগে শক্ত বার্তা দিয়েছে। তবে গ্রাহকদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ কতটা হবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
এম আর এম – ১৩৯৯,Signalbd.com