বিশ্ব

২০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ৩৫ হাজার হামলা

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ২০ মাসের সশস্ত্র আক্রমণের বিশ্লেষণ

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের নামে গত ২০ মাসে প্রায় ৩৫ হাজার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে শুরু করে সিরিয়া, লেবানন, ইরান ও ইয়েমেন—এই পাঁচটি দেশে ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক হানা ঘটেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পর্যবেক্ষক সূত্রে উঠে এসেছে এই তথ্য, যা মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংঘাতের গভীরতা বোঝাতে সাহায্য করে।

ইসরায়েলের হামলার পরিসংখ্যান ও বিস্তৃতি

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট (এসিএলইডি) গত ২০ মাসে এই সংঘর্ষের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় শুরু হওয়া ইসরায়েলের হামলা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার ২৩৫টি হামলা হয়েছে শুধু ফিলিস্তিনে।

লেবাননে হামলার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫২০। সিরিয়ায় ৬১৬টি, ইরানে ৫৮টি এবং ইয়েমেনে ৩৯টি হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলাগুলোতে ইসরায়েল যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাবর্ষণ ও দূরনিয়ন্ত্রিত বোমার ব্যবহার করেছে। সম্পত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি জনবসতি এলাকা এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটিও লক্ষ্যবস্তু ছিল।

গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিনের ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট

গাজায় ইসরায়েলের হামলা চালানোর সময়কাল এখন ৬২৮ দিন পার করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শিশু, মহিলা ও বয়স্করাও এর মধ্যে রয়েছেন। গাজার ধ্বংসযজ্ঞ শুধু সামরিক নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেছে।

একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের আগ্রাসন আরও বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ মাসে প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলে জমি দখল ও বসতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্যাতন ও হামলা চালিয়ে আসছে।

লেবানন ও সিরিয়ায় সংঘাতের বিস্তার

২০২৩ সালের থেকে শুরু হওয়া লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত প্রায় ১৪ মাস ধরে চলে। ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে যায়। সংঘাত চলাকালীন সীমান্ত অঞ্চলে হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

সিরিয়ার পরিস্থিতিও অজস্র হামলার শিকার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের ঠিক দুই দিন পর, ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা শুরু করে। প্রধান বিমানবন্দর, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কৌশলগত জায়গা লক্ষ্য করে প্রায় ২০০টির বেশি হামলা চালানো হয়েছে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি

২০ মাস ধরে ইসরায়েলের হামলার মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হলো ইরান। ২০২৫ সালের ১৩ জুন থেকে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ শুরু হয়। প্রায় ১২ দিন টানা সংঘর্ষের পর ২৩ জুন দুপক্ষ যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়।

ইরানের রাজধানী তেহরানে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দিন এক ইরানি নারী বাসার সামনে দাঁড়িয়ে বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে শান্তির বার্তা দিয়েছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করেছে।

ইয়েমেনে ইসরায়েলের হুতি বিরোধী অভিযান

ইয়েমেনে ইসরায়েলি বাহিনী হুতি আন্দোলনের নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোতে হামলা চালিয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ থেকে এই হামলা তীব্র আকার নেয় এবং ২০২৫ সালেও অব্যাহত রয়েছে। ইয়েমেনের চলমান গৃহযুদ্ধ ও সামরিক সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইসরায়েলের এই আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইসরায়েলের সামরিক কৌশল ও মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা

এই দীর্ঘদিনের সংঘাতের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে ইসরায়েল আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও দূরনিয়ন্ত্রিত বোমার মাধ্যমে দ্রুত ও নিখুঁত হামলা চালাচ্ছে। তবে এই কৌশলগুলোর ফলে সাধারণ জনগণের ক্ষতিও মারাত্মক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইসরায়েলের এই হামলা শুধুমাত্র সামরিক লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং রাজনৈতিক দখলদারিত্ব এবং ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতেই এ ধরনের আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় এসব হামলা ভূখণ্ড দখল ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরায়েলের এক পরিকল্পিত কৌশল হিসেবে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার পরিস্থিতি

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের ওপর অবিলম্বে হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য সংকট ও শরণার্থী সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য বড় একটি মানবিক বিপর্যয়।

বিশ্বজুড়ে শান্তি আন্দোলন চলছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো হচ্ছে।

শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা

মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংকট ও চলমান সংঘাতের এই ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দেয়—কবে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে? রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই পারে এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে। বিশ্ববাসী প্রত্যাশা করছে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ যেন দখলদারিত্ব ও সহিংসতা থেকে মুক্ত হয়ে স্থায়ী শান্তি অর্জন করতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button